Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

দূষণরোধে ভূমিকা রাখবে ঢাকার খাল

মো. কামাল হোসেন

জুন ২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


দূষণরোধে ভূমিকা রাখবে ঢাকার খাল
  • দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ মোকাবিলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এই দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বায়ু নয় ঢাকা শহরের পরিবেশ নিয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ঢাকা ছিলো একসময় মুঘলদের কাছে আকর্ষণীয় শহর। প্রাকৃতিক সুবিধাই মুঘলদের ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে আকর্ষণ করে। এখনকার ঢাকা শহর দেখে বোঝার উপায় নেই যে, মাত্র একশ বছর আগেই ঢাকার ভৌগোলিক পরিবেশ কতটা মনোরম আর স্বাস্থ্যকর ছিলো। দুনিয়ায় এমন রাজধানী খুব কমই আছে যার চারপাশে বৃত্তাকারে বেষ্টিত করে রেখেছে অনেকগুলো বড় নদী। ইতালির ভেনিস নগরীর সাথে একে অনেকেই তুলনা করতো। চারপাশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, টঙ্গী ও তুরাগের মতো পাঁচটি নদী আর ভেতর দিয়ে শতাধিক খালের প্রবাহ আর উপকণ্ঠজুড়ে বিস্তীর্ণ বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল নিয়ে এক সময় ঢাকা প্রাকৃতিকভাবেই ছিলো জলাবদ্ধতাবিহীন পরিবেশবান্ধব নগরী। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিমত জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপই ঢাকা শহরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। এই শহরের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে সেটি বজায় থাকলে শহরের পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণের হার আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকবে। আর বর্তমানের মতো পরিবেশ দূষণ চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা শহর হতে পারে বসবাস অনুপোযোগী শহর। বলা হয়ে থাকে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর যে বিষয়গুলো প্রভাব ফেলে তার মধ্যে পুষ্টির পরেই পরিবেশের অবস্থান। ঢাকার পরিবেশদূষণ কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি তুলে ধরেছে বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সামপ্রতিককালে বেশির ভাগ সময় ঢাকা ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর।

দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ মোকাবিলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এই দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। তবে সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বায়ু নয় ঢাকা শহরের পরিবেশ নিয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশুদ্ধ এবং সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। এ সংকটের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলাশয় কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। গাছপালা কমে যাওয়া বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাবও ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। গাছপালা মানুষের নির্গত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয় পরিবেশে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়ের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। এটা পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। ভূখণ্ডের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলে। ভূখণ্ডের উপরের জলাশয় কমে যাওয়ায় দিন দিন মাটির গভীরের পানির স্তরও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে আরো নিচে। নগরবিদরা বরাবরই বলে আসছেন ঢাকার ভারসাম্যহীন পরিবেশের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এমনকি আবাসিক এলাকা, কোনোটাতেই নেই সঠিক ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার ছাপ। পরিবেশ দূষণের কারণে সবার জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত, বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষণের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর, টেকসই ও পরিবেশসম্মত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবিলায় বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের রয়েছে অনেক আইন ও বিধি। এর মধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও কর্মকৌশল-২০০৯, জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১২ এবং জাতীয় পরিবেশ পদক নীতিমালা-২০১০ অন্যতম। বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাতের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন এবং প্রশমন বা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস— এ দুই খাতেই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমপ্রতি সরকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭ জারি করেছে। প্রকৃতির ক্ষতি করে, পরিবেশ বিনষ্ট করে ভালো থাকা যায় না, সুন্দরভাবে জীবন যাপন করাও সম্ভব নয়। মানুষের যেমন মূল্য আছে, পরিবেশেরও তেমনি মূল্য আছে। ঢাকা শহরের পরিবেশ উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সমপ্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে।

ঢাকার পরিবেশ উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে খাল পুনরুদ্ধার, অবৈধ দখলমুক্ত, সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগকে নাগরিক সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঢাকার খালগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেতো। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় নৌপথের মাধ্যমেই মালামাল পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটতে থাকে। সেই সময়ের যোগাযোগ প্রধানত নৌপরিবহন ব্যবস্থার ওপরই নির্ভরশীল ছিলো। নদী নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। তবে ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৫৮টি। তখন জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এসব খালের মধ্যে ৩৭টি খালেই দখলদার রয়েছে। ফলে এসব খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। আর বাকি সব কটি খালের জায়গায় রাস্তা হয়েছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উন্নয়নের নামে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। আজ অবশিষ্টগুলোও সঙ্কটাপন্ন। যেসব খাল দিয়ে একসময় স্টিমার চলতো এখন সেখান দিয়ে নৌকাও চলে না। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিলো, তা আজ বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, পানি সঙ্কট এবং হ্রাস পাচ্ছে মৎসসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য। আমাদের নানা অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। খালগুলো ভরাট করে ভবন, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ড্রেন বানানো হয়েছে। ঢাকার কোনো কোনো খাল সবার চোখের সামনেই সরাসরি, আবার কোনটি আবর্জনা ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মূলত স্বাধীনতার পর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঢাকা শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সাথে নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট হতে থাকে। যার ফলাফল হিসেবে নব্বই সালের পর থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতা সংকট প্রকটতর হচ্ছে।

লেখক : গণসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই