Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে সীমান্তের জেলা

মাহমুদুল হাসান

জুন ৫, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে সীমান্তের জেলা
  • ভয়াবহ সঙ্কটে ১১ জেলা
  • রামেকে গত ১৩ দিনে ১০১ জনের মৃত্যু
  • সীমান্তবর্তী জেলা থেকে চারদিকে ছড়াচ্ছে
  • চলতি মাসে ঘটতে পারে দেশজুড়ে সংক্রমণ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যাচ্ছে ভয়াবহতার দিকে। প্রথম ঢেউ রাজধানী ও তার আশপাশে ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হলেও এবার ভিন্নচিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। সীমান্ত থেকে সারা দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। গত ৮ মে দেশে প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলেও ইতোমধ্যে করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলা— চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা ও নওগাঁতে সীমাবদ্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে পাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম করোনার নতুন এই ধরনটি বিশ্বের অন্তত অর্ধশত দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দেশে নতুন যারা শনাক্ত হচ্ছে তাদের অধিকাংশের ভারতসহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে— মত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। ভাইরাসটির প্রকোপ রুখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে চাঁপাইনবাবগঞ্জ,  রাজশাহী, নওগাঁ ও সাতক্ষীরাকে স্থানীয়ভাবে লকডাউনের সিদ্ধান্ত প্রশাসনে। জেলাগুলোর সীমান্তে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ও পুলিশের তল্লাশি চৌকির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। তবুও জেলা থেকে জেলায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, আবারো দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের ১১ জেলায় উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তবে এই ধরনেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, করোনা যতদিন থাকবে নতুন নতুন ধরনও আসবে। তবে জনগণকে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতেই হবে। তাহলে সব ধরনই আটকানো যাবে। এসব স্বাস্থ্যবিধি মানতে অবহেলা করলে ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণের কারণে জুন মাসে করোনা আবার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঈদের পর থেকে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মৃত্যু। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। শুধু গত ২৪ মে দুপুর থেকে ৫ জুন পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমিত ছিলেন ৬০ জন। অন্যরা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ২৪ মে ১০ জন, ২৫ মে চারজন, ২৬ মে চারজন, ২৭ মে চারজন, ২৮ মে ৯ জন, ৩০ মে সর্বোচ্চ ১২ জন, ৩১ মে চারজন, ১ জুন সাতজন, ২ জুন সাতজন, ৩ জুন ৯ জন, ৪ জুন ১৬ জন ও গতকাল আরও আটজন মারা গেছেন। গতকাল মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে করোনা পজেটিভ হয়ে চারজন ও উপসর্গ নিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া তিনজন রাজশাহীর ও পাঁচজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মৃতদের মধ্যে তিনজন করোনা পজেটিভ, রাজশাহীর মৃত তিনজনের মধ্যে দুজনের করোনা পজেটিভ ছিলো। গতকাল সকাল পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২২৪ জন রোগী। এদের মধ্যে ১১১ জন পজেটিভ এবং বাকিরা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন। নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে রাজশাহীর ১০ জন, চাঁপাইয়ের পাঁচজন ও নওগাঁর একজন। বর্তমানে আইসিইউতে আছেন ১৬ জন রোগী। একই সময়ে ৯৪ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের করোনা পজেটিভ হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, নতুন রোগী শনাক্ত, সুস্থ হওয়া রোগীর সংখ্যা ও করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে। চলতি সপ্তাহে (৩০ মে থেকে ৫ জুন) পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১১ লাখ ৯ হাজার ২০২টি। আর গত সপ্তাহে (২৩ মে থেকে ২৯ মে) পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১০ লাখ ৯ হাজার ৬৫১টি। অর্থাৎ গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার হার বেড়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। একইভাবে চলতি সপ্তাহে রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৯২৮ জন আর গত সপ্তাহে রোগী শনাক্ত হন ৯ হাজার ৬৬০ জন। আগের সপ্তাহের চেয়ে চলতি সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। একইভাবে চলতি সপ্তাহে সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ১৭ জন আর গত সপ্তাহে সুস্থ হয়েছিলেন সাত হাজার ৬১০ জন। অর্থাৎ, সুস্থ হওয়ার হারও বেড়েছে ৫৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। চলতি সপ্তাহে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৫২ জন আর গত সপ্তাহে মারা গেছেন ২০১ জন। চলতি সপ্তাহে আগের সপ্তাহের চেয়ে মৃত্যুহার বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

জেলায় জেলায় বিপর্যয় : গত কয়েকদিনে সাতক্ষীরায় গড়ে ৫৭ শতাংশের ওপর রোগী শনাক্ত হয়েছে। আশঙ্কাজনকভাবে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় গতকাল শনিবার থেকে সাতক্ষীরা জেলায় এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, লকডাউনের এক সপ্তাহে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটার জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকবে। তবে ফার্মেসি, হাসপাতাল, ক্লিনিক, অ্যাম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। এ সময় দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে মোটরসাইকেল চলাচলও। সাতক্ষীরার সঙ্গে যশোর ও খুলনার সড়ক যোগাযোগে পয়েন্টগুলোতে পুলিশ চেকপোস্ট থাকবে। এ সময় সীমান্তে পারাপার বন্ধ থাকবে। শহরে থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিধি-নিষেধ অমান্যকারীদের জরিমানা করা হবে। এদিকে সপ্তাহজুড়ে ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েছে করোনা রোগীর সংখ্যা। গতকাল করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন একজন। গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে কয়েকগুণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে আধুনিক সদর হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ১৩ জন। গত শনিবার থেকে ছয়দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৩ জন। এছাড়া মোংলায় করোনা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। গতকাল ৪৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩৪ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। এতে মোংলায় আক্রান্তের হার ৭০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। গত ২৮ মে থেকে ৫ জুন আটদিনে মোট ২১৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৩৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন মোট আটজন। তবে সরকারি হিসাব মতে, চারজনের তালিকা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘শনাক্ত হারের বিপরীতে বর্তমানে দেশের ১১ জেলায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গত ১ জুন তাদের বৈঠকে করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে মনে করেন তারা। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী (রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ এবং খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট) এলাকায় সংক্রমণের উচ্চহার দেখা গেছে। এ ছাড়াও আরও কিছু জেলাতে উচ্চ সংক্রমণ রয়েছে। এ ছাড়াও কমিটির এক সূত্র জানায়, এ আট জেলা ছাড়াও সিলেট, কক্সবাজার ও ফেনীতেও সংক্রমণের উচ্চহার রয়েছে। করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের সামাজিক সংক্রমণও হয়েছে। আর এটা যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তাই অবস্থা বিবেচনায় সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই এবং এতে জনপ্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সারা দেশে সরকার ঘোষিত বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে পালন করতে হবে জানিয়ে সীমান্তবর্তী জেলা ও উচ্চ সংক্রমিত এলাকায় সম্পূর্ণ লকডাউন দেয়া জরুরি বলে সুপারিশ করে কমিটি।

আমারসংবাদ/জেআই