Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪,

প্রকৃতি রক্ষাই আগামীর টেকসই ভবিষ্যৎ

আসাদুজ্জামান আজম

জুন ৫, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


প্রকৃতি রক্ষাই আগামীর টেকসই ভবিষ্যৎ

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত মানোন্নয়ন করেই আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই ভবিষ্যত নির্ভর করছে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে পৃথিবীতে মানববসতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। যার কারণে পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলছে।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশ বিপর্যয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসাবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। পৃথিবীব্যাপী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভগুলো মনুষ্য কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগে মানুষ ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয় রোধ এবং পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে। একদিকে যেমন সচেতনা বাড়াতে কাজ চলছে, উল্টো দিকে ধ্বংসের কাজ চলছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংরক্ষণ কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির উদ্যোগে ১৯৭২ সাল থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। করোনা সংকটের মধ্যে এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ এবং স্লোগান ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’ নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গতকাল পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ২০২০ এবং ২০২১ পরপর দুই বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যে জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘ ২০২১ থেকে ২০৩০ দশককে ইউএন ডিকেড ইকোসিস্টেম রোটেশন হিসেবে ঘোষণা করেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ রক্ষায় বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তি উপলক্ষেও নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।

গতকাল শনিবার সকালে গণভবনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গণভবন চত্বরে ডুমুর ও সোনালু প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করে এই কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ সময় বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমি নিজে বৃক্ষ রোপণ করলাম। সেই সঙ্গে দেশবাসীকে আহ্বান জানাবো, যার যেখানে যতটুকু জায়গা পান অন্তত গাছ লাগান। তিনটি করে গাছ লাগাতে পারলে সব থেকে ভালো হয়। আর সেটি যদি না পারেন অন্তত একটি গাছ লাগালেও ভালো হবে। আমরা চাই যে, একটি ফলজ, একটি বনজ ও একটি ওষুধি এই ধরনের গাছ লাগাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশ উন্নয়ন দেশ, আমরা এগিয়ে যাবো। বনায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সাফল্য। আমরা যে ব্যবস্থা নিয়েছি তার ফলে আজকে আমাদের প্রায় ২২ ভাগ বনায়ন সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া ব্যাপকভাবে পারিবারিকভাবে বিভিন্ন বাগান সৃষ্টি, পুষ্টি বাগান সৃষ্টি হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সকলে এখন সচেতন। কাজেই গাছ আমাদের জীবন, গাছ আমাদের অনেক উপকার করে। সে জন্য সকলকেই আমি আহ্বান জানাবো, পরিবেশ রক্ষায় এবং আপনার নিজের আর্থিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে, সবদিক থেকেই যেটা সব থেকে উপযোগী সেটা হচ্ছে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য রক্ষা অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩ জারি করেন।  পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নামে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাম পরিবর্তন করে পরিবেশ অধিদপ্তর করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।’ পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ তাই, জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এখন আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর এ বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নে নির্মোহভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি করে এক হাজার ৮৭ জনে উন্নীত করেছে এবং দেশের সবকটি জেলায় (৬৪টি জেলা) অফিস চালু করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ১৯৯২ সালে প্রথম পরিবেশ নীতি, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০১০ সালে পরিবেশ আদালত আইন বলবৎ করে। জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে লাল শ্রেণিভুক্ত সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ ও পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হওয়ার সম্ভাব্য সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬-এর নিষিদ্ধ কার্যক্রসমূহ দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ‘প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় সমাজভিত্তিক অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। টাঙুয়ার হাওরের প্রতিবেশ সুরক্ষায় আগে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সমুদ্র প্রতিবেশ সংরক্ষণ, সমুদ্রদূষণ রোধ, সমুদ্র সম্পদ আহরণে ও সমুদ্র সম্পদের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্লু-ইকোনোমি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সমুদ্র জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশসম্পদ জরিপ সম্পাদনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পাহাড় কর্তন রোধকল্পে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধনীতে (২০১০ সালে আনীত) পাহাড় কাটা বন্ধের লক্ষ্যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পাহাড় কর্তনরোধে নিয়মিত মনিটরিংসহ গণসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুনভাবে গৃহীত জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ সালে আগের ১৫টি খাতসহ আরও ৯টি খাত-ক্ষেত্রের মধ্যে পাহাড় প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ এবং জীবনিরাপত্তা, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন ইত্যাদি খাতসমূহকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত জীবের গবেষণা ও উন্নয়নকাজে নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জীবনিরাপত্তা বিধিমালা ২০১২ ও জীবনিরাপত্তা গাইড লাইন ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। জীবনিরাপত্তা বিষয়ে সামর্থ্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই