Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বদলে যাচ্ছে ঢাকার চারপাশের নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুন ৫, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


বদলে যাচ্ছে ঢাকার চারপাশের নদী
  • লকডাউনের কারণে গত মাসে অভিযান বন্ধ থাকলেও জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে নদীতীরে অভিযান চালিয়ে চার হাজার ১৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ১১৩ একর ভূমি অবমুক্ত করে বিআইডব্লিউটিএ

ভরাট, দখল আর দূষণে ঢাকার চারপাশের নদী হয়ে গেছে খাল, খাল পরিণত হয়েছে নর্দমায়। এছাড়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর পানিও হয়ে গেছে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। ঢাকার চারপাশের সেই নদীগুলো বেদখল থেকে রক্ষার পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে সরকার গ্রহণ করে মহাপরিকল্পনা। সে পরিকল্পনাও আজ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি তিন পর্যায়ে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও চলমান করোনা সংকটে সার্বিক কার্যক্রমে পড়ছে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাবও।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি সূত্র জানায়, জানুয়ারি থেকে শুরু করে গত এপ্রিল পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নদীর তীরবর্তী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ভূমি অবমুক্ত করার কার্যক্রম চললেও গত মাসে লকডাউন থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এর আগে এপ্রিল পর্যন্ত মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে চার মাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর তীরে অভিযান চালিয়ে চার হাজার ১৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া ১১৩ একর ভূমিও করা হয় অবমুক্ত। উচ্ছেদকৃত এসব নদীর তীরে প্রথমপর্যায়ে স্থাপন করা হবে ১০ হাজার সীমানা পিলার, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তিনটি ইকোপার্কসহ ১৯টি জেটি। সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অধীনে বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। বিনোদনের জন্য ইকোপার্ক নির্মাণ করা হবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এবং তুরাগ নদীর তীর আশুলিয়া ও টঙ্গীতে। এছাড়া কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া এলাকায় হেলিপ্যাড নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে বিআইডব্লিউটিএর সূত্র জানায়।

এদিকে ঢাকার চারপাশে নদী দখল ও দূষণরোধে ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ ও বনায়ন তৈরির কাজও চলমান রয়েছে। এছাড়া নদী দূষণরোধে বর্জ্যের উৎসমুখ বন্ধ করে বর্জ্য দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও করেছে সরকার। নদীগুলো দূষণ ও দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে চূড়ান্ত মাস্টারপ্ল্যানটি তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। দূষণ, দখল এবং নাব্য। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ, দখল এবং নাব্য বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাসমূহের শাখা নদী ও খালগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই তৈরি করা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানটি। এছাড়া ‘নদী দূষণ প্রতিরোধ কমিটি-২০০৮’ এর প্রতিবেদন বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান বর্তমান প্রজেক্টসমূহ পর্যালোচনা করে এই মহাপরিকল্পটি তৈরি করা হয়। দূষণ, দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধিকল্পে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে চারটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো— এক বছরের মধ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, তিন বছরের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি, পাঁচ বছরের মধ্যে মধ্যমেয়াদি এবং ১০ বছরের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ বিষয়ে নদীরক্ষা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ধাপে ধাপে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথমপর্যায়ে নদীগুলো ড্রেজিং করতে হবে। পলি পড়ে নদীর বেডগুলো উঁচু হয়ে গেছে, সেগুলোকে আগের জায়গায় নিতে হবে। পানি দূষিত হয়ে গেছে, পানি ট্রিট করতে হবে। পানিতে আর যাতে দূষিত পদার্থ না যায় সেজন্য সোর্সগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য যাতে আর নদীতে না যায়, সে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও পরিকল্পনায় রয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে আমরা ডিসপোজাল করে দেবো। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত টাকা লাগবে তা ওয়ার্কিং গ্রুপ নির্ধারণ করবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজগুলো ভাগ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। ইতোমধ্যে সেই কাজ শুরুও হয়ে গেছে। তিনি বলেন, একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তারা অনুমোদিত এই খসড়া এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করবেন। প্রাথমিকভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এজন্য নদীর তীর দখলমুক্ত করা হচ্ছে, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এরপর ওয়াসার নেতৃত্বে স্যানিটেশনের কাজ শুরু হচ্ছে। দূষিত পানি যেনো নদীতে না যায় সেজন্য ঢাকার স্যুয়ারেজ লাইনও ঠিক করার কথা রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। বর্জ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। বর্জ্য যাতে নদীতে এখানে সেখানে ডাম্প করা না হয় সেজন্য বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতেও কাজ করছি।

বিআইডব্লিউটিএর সূত্র জানায়, নদীরক্ষার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর দুই তীরে অবৈধ স্থাপনায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব নদীর তীরে অভিযান চালিয়ে ৯ হাজার ৮৯২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় ২৭৭ দশমিক ৬৭ একর তীর ভূমি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত তীর ভূমিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ৮৪৮ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা তীর ভূমিতে পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

এর মধ্যে নদীর দুই পাড়ে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তীর রক্ষা বাঁধ, ভরাটকৃত মাটি খনন, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি, এক কিলোমিটার কি-ওয়াল, সেতু ও রেলিং নির্মাণ, ৪০৯টি বসার বেঞ্চ, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, তিনটি ইকোপার্ক, ১৯টি জেটি, ছয়টি লংবুম এক্সেভেটর ক্রয় ও নদীর তীরে বনায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তিন হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ছয়টি লংবুম এক্সেভেটর, এক হাজার বৃক্ষরোপণ শেষ হয়েছে। এছাড়া ওয়াকওয়ে, জেটি ও ইকোপার্ক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ঢাকার চারদিকে নৌপথে একটি দৃষ্টিনন্দন ও কার্যকরী নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পে নতুন কিছু স্থাপনা সংযোজন করে সংশোধিত প্রকল্প (আরডিপিপি) তৈরি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আরডিপিপির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এর মাটি খনন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, সাত হাজার ৫৬২টি স্থায়ী সীমানা পিলার, ৮০টি আরসিসি জেটি, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ১৪টি ভারী জেটি, পার্কিং ইয়ার্ড, তিনটি রাস্তা নির্মাণ, ইকোপার্ক, সীমানা প্রাচীর, রেলিং, সেতু কি-ওয়াল নির্মাণ, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জে চারটি ঘাট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চলমান দ্বিতীয় পর্যায় এবং প্রস্তাবিত তৃতীয়পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার চারপাশে ১১০ কিলোমিটার নৌপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এছাড়া নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার তীরভূমিতে স্থায়ীভাবে সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে, আরসিসি জেটি, ইকোপার্ক ও বনায়নের মাধ্যমে নদী দখল-দূষণ রোধ হবে ও নদীতীরের পরিবেশ দৃষ্টিনন্দন হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

আমারসংবাদ/জেআই