Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

এমন উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক সব কারখানায়

মো. আকতারুল ইসলাম

জুন ৫, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


এমন উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক সব কারখানায়
  • কারখানাপর্যায়ে টিম গ্রুপের মতো এমন দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করলে গার্মেন্টশিল্প আরও একধাপ এগিয়ে যাবে’। টিম গ্রুপের মতো এমন বাস্তবসম্মত এবং উদাহরণ সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ যদি প্রতিটি কারখানা মালিক গ্রহণ করেন তাহলে গর্ভধারণ আর সন্তানের লালন-পালনের জন্য কোনো দক্ষ নারীকর্মী চাকরি ছাড়বে না। গার্মেন্টসহ সকল কারখানায় দক্ষ নারীকর্মীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং সার্বিক উৎপাদনব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে

শত শত কর্মী নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কিছু নারীকর্মীর মাথায় লাল স্কার্ফ। এখানে কোনো নারী শ্রমিক অন্তঃসত্ত্বা হলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি প্রথমেই লাল স্কার্ফ হাতে তুলে দেয়। এ স্কার্ফ পরা দেখলেই সবাই বুঝতে পারেন তারা অন্যদের থেকে আলাদা। তাই তাদের কাজে ভুল হলে ধমক দেয়া নিষেধ। প্রথম মাস থেকেই কাজের চাপ কমিয়ে দেয়া হয়। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ওজন মাপা, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ানো, রক্তচাপ মাপা ও প্রতিদিন সকাল ১১টায় দুধ ও ডিম খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে মালিকপক্ষ। প্রশংসনীয় এ চিত্র সাভারের বাইপাইল এলাকার কাইচাবাড়ীর টিম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানার। জানা গেলো টিম গ্রুপের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ছয়টি গার্মেন্টে বর্তমানে তিনশো নারী শ্রমিক অন্তঃসত্ত্বা। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গত ৫ মার্চ বাইপাইলের কাইচাবাড়ীর এইয়ান ডাইং লিমিটেডে ‘প্রসূতি মায়ের যত্ন ও সম্মান- ভালো কর্ম পরিবেশের অবদান’ শিরোনামে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এসব নারীকে সম্মাননা জানানো হয়।

এ বিষয়ে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, নারীদের কাজের স্বীকৃতি দিলে জাতি এগিয়ে যাবে। তারাই পারে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়তে। তিনি জানান টিম গ্রুপ ১৫ হাজার ৮০০ জনের একটি পরিবার। টিম গ্রুপে কর্মরত নারীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য আলাদাভাবে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

বলা হয়ে থাকে, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকরা বেশি নিষ্ঠাবান। নারী শ্রমিকের ওপর ভিত্তি করেই এক সময় দেশে তৈরি পোশাক কারখানা যাত্রা শুরু করে। অল্প দামে শ্রম পাওয়ায় এক সময় দেশে বিস্তার লাভ করে তৈরি পোশাকশিল্প। আর সেই নিষ্ঠা ও দক্ষতা দিয়েই বাংলাদেশের নারীরা সচল রেখেছেন দেশের তৈরি পোশাক কারখানার চাকা।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেয়া তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় হয় ১১ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই আয় ২৭.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। যদিও ২০২০ সালজুড়ে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের কারণে এই আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে। তারপরও দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ ভাগ আসে এই পোশাক খাত থেকে। চীনের পর একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন কারণে দেশের পোশাকশিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমেছে, গত জুলাই থেকে আগস্টে এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট-এসিডি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে পোশাক খাতে এখন মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। ৫ বছর আগে পোশাক খাতে মোট ৪০ লাখ ১ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিলো ২৫ লাখ ৯১ হাজার। ৫ বছরে পোশাক খাতে ২ লাখ ১৯ হাজার শ্রমিক যুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ হারে শ্রমিক বেড়েছে পোশাক খাতে। এই সময়ে পোশাক খাতে পুরুষের অন্তর্ভুক্তির প্রবৃদ্ধি ছিলো ৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রতিবছর নারী শ্রমিক কমেছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে। তৈরি পোশাক কারখানায় অনেক দক্ষ নারী শ্রমিক গর্ভবতী থাকেন। তাদের অনেকেই সন্তান জন্মদানের পর সন্তানের যত্ন, নিরাপত্তার কথা ভেবে কাজে ফিরে আসেন না। অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় ডে কেয়ার সেন্টার না থাকায় অনেকে দক্ষ নারী শ্রমিক হারাচ্ছে, যারা সন্তানকে বাড়িতে রেখে কাজে যোগ দেন। শিশুটি মায়ের বুকের দুধ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে ওই শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। শিশুর জীবনের ঝুঁকি কমাতে প্রত্যেক পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষকে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর ফিরে আসা কর্মজীবী মাকে তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে।

সিপিডির গবেষণা বলছে, একজন নারী শ্রমিক গড়ে সাত বছরের বেশি কাজ করতে পারেন না। সন্তানের চিন্তায় উদ্বিগ্ন মায়ের কাছ থেকে কখনই শতভাগ আউটপুট আশা করা যায় না। বাংলাদেশ শ্রম আইনের (২০০৬) শিশু কক্ষ সংক্রান্ত ৯৪(৭) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উক্তরূপ কোনো কক্ষ যথেষ্ট আসবাবপত্র দ্বারা সজ্জিত থাকিবে এবং বিশেষ করিয়া প্রত্যেক শিশুর জন্য বিছানাসহ একটি খাট বা দোলনা থাকিবে এবং প্রত্যেক মা যখন শিশুকে দুধ পান করাইবেন বা পরিচর্যা করিবেন, তখন তাহার ব্যবহারের জন্য অন্তত একটি চেয়ার বা এই প্রকারের কোনো আসন থাকিতে হইবে এবং তুলনামূলকভাবে বয়স্ক শিশুদের জন্য যথেষ্ট ও উপযুক্ত খেলনার সরবরাহ থাকিতে হইবে।”

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ অধীনস্থ দপ্তর-সংস্থা এসব বিষয়গুলোতে কাজ করছে। শ্রম অধিদপ্তরের অধীনে নতুন দুটি কর্মজীবী হোস্টেল নির্মাণ করা হচ্ছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সারা বাংলাদেশ ৫ হাজার ৫৫৭টি কলকারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোকে পরিচালনায় কারখানা মালিকদের আরও যত্নবান এবং দায়িত্বশীল হতে হবে।

তবে নির্দিধায় বলা যায়, নারীর কর্মপরিবেশের উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তৈরি পোশাক খাত বড় বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মপরিবেশ নিয়ে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়েছে কিংবা হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্য সুবিধার বিষয়টিও দেখতে হবে।

এসআরএইচআর অ্যান্ড জেন্ডার নিয়ে কাজ করা মাশফিকা জামান সাতিয়ার বলেন, তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের চেয়ে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা বেড়েছে। অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ নারীর স্বাস্থ্যের বিষয়টিও দেখছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে। কারখানাগুলো এটা বুঝেছে যে, উৎপাদন বাড়াতে হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যে নজর দিতে হবে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ প্রচেষ্টার ফলেই এ পরিবর্তন এসেছে। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকরা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন— এই স্বীকৃতি বড় প্রাপ্তি। তবে, তার বিপরীতে নারীদের সামাজিক মূল্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম বলেন, ‘গার্মেন্টশিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস পালন করছি। কারখানাপর্যায়ে টিম গ্রুপের মতো এমন দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করলে গার্মেন্টশিল্প আরও একধাপ এগিয়ে যাবে’। টিম গ্রুপের মতো এমন বাস্তবসম্মত এবং উদাহরণ সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ যদি প্রতিটি কারখানা মালিক গ্রহণ করেন তাহলে গর্ভধারণ আর সন্তানের লালন-পালনের জন্য কোনো দক্ষ নারীকর্মী চাকরি ছাড়বে না। গার্মেন্টসহ সকল কারখানায় দক্ষ নারীকর্মীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং সার্বিক উৎপাদনব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। সেই সাফল্যে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন পালক। টিম গ্রুপের মতো এমন উদ্যোগ সব কারখানায় ছড়িয়ে পড়লে দক্ষ জনশক্তি দিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০৪১-এর আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়া সহজ হবে।

লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই