Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

বজ্রপাতের হটস্পট বাংলাদেশ!

জুন ৮, ২০২১, ০৫:৫৫ পিএম


বজ্রপাতের হটস্পট বাংলাদেশ!
  • বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষ দূষণ বজ্রপাত বাড়ার অন্যতম কারণ
  • জুনের প্রথম সপ্তাহে মৃত্যু ৫৬, সবশেষ ৪৮ ঘণ্টায় ৩৩, সরকারি হিসাবে বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট মৃত্যু ১১০, বেসরকারি ২৩০
  • দেশের মধ্যাঞ্চল (নেত্রকোনা, নরসিংদী ও কুমিল্লা) বজ্রপাতের হটস্পট — ড. আবদুল মান্নান, আবহাওয়াবিদ
  • বড় বড় গাছ কমে যাওয়ায় বজ্রাঘাতে মৃত্যু বেড়েছে —বলছেন গবেষকরা
  • বজ্রপাত প্রতিরোধে এক কোটি তালগাছ রোপণ প্রকল্পের ৩৮ লাখ লাগানো হয়েছে। এছাড়া সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু, লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপন ও হাওরাঞ্চলে শেল্টার ছাউনি করছে সরকার —ডা. এনামুর রহমান, প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

বজ্রাঘাতে কৃষক, জেলে, তরুণ ও কিশোরের মৃত্যু থামছেই না। বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহেই সারা দেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় ৫৬ জনের। এর মধ্যে ৭ জুন ৯ জন, ৬ জুন ২৫ জন, ৫ জুন সাতজন, ৪ জুন ৯ জন, ৩ জুন পাঁচজন এবং ১ জুন একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ২ জুন কারো মৃত্যুর খবর জানা না গেলেও একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিলো ৬ জুন ২৫ জন।

গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, গত ৪৮ ঘণ্টায় সারা দেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩ জন। সবমিলিয়ে চলতি বছরের জুন নাগাদ সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১০ জনে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি, ২৩০ জন।

গবেষকরা বলছেন, গড়ে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা দুইশর বেশি। বড় বড় গাছ কমে যাওয়ায় বজ্রাঘাতে মৃত্যু বেড়েছে। গবেষকরা আরও জানান, গত ১০ বছরে বজ্রাঘাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৮ সালে, ৩৫৯ জন। গবেষকরা আরও জানান, নাসার তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতের অন্যতম হটস্পট বাংলাদেশ। এদিকে চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, টাঙ্গাইল, রংপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নেত্রকোনা, সিলেট ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর এসব ঘটনা ঘটলেও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মধ্যাঞ্চলই বজ্রপাতের হটস্পট। এর মধ্যে তথ্য পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা জানান, নেত্রকোনা, নরসিংদী ও কুমিল্লা- এ তিন জেলাই বজ্রপাতের হটস্পট। দেশের এসব এলাকার মাঠে-ঘাটে-ছাদে বজ্রাঘাতে স্বল্প সময়ে কৃষক, জেলে, তরুণ ও কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে উদ্বেগজনক হারে। তবে বজ্রপাত প্রতিরোধ এবং মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার প্রচেষ্টায় সরকার ইতোমধ্যে পূর্বাভাস স্টেশন, আশ্রয় ছাউনি, তালগাছ রোপণ প্রকল্পসহ বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে আমার সংবাদকে জানিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন আর মানুষের সচেতনতাই কমাতে পারে বজ্রাঘাতে প্রাণহানির ঘটনা —এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান বলেন, দেশে বজ্রপাতের ‘হটস্পট’ হচ্ছে মধ্যাঞ্চল। মার্চ-এপ্রিল-মে মাস বজ্রপাতের জন্য অনকূল পরিবেশ বিরাজের প্রবণতা থাকলেও মৌসুমগত পরিবর্তনের কারণে মে-জুলাইয়েও তা বিস্তৃত হতে পারে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, টাঙ্গাইল, রংপুর ও মুন্সীগঞ্জে গত রোববার বজ্রাঘাতে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে কেউ গরু আনতে গিয়েছিলেন মাঠে, কেউ বাড়ির পাশে মাঠে ধান কাটছিলেন, কেউ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলেন, কেউ বাড়ির উঠানে ও স্কুলের মাঠে খেলছিলেন, কেউবা পাট ক্ষেতে কাজ করছিলেন।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য, তেমনই আরেকটা কারণ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। আর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত দূষণ। দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রা তত বাড়ছে। ফলে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হওয়ার আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান বলেন, ঊর্ধ্বাকাশে এখন প্রচুর জলীয় বাষ্প রয়েছে। এ সময় উত্তর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়াও ধাবমান। একদিক থেকে গরম ও আর্দ্র হাওয়া আর অন্যদিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস- এমন পরিস্থিতিতে বজ্রপাতের ঘটনাই স্বাভাবিক, যা কয়েক ঘণ্টার স্বল্প সময়ের মধ্যে তীব্র রূপ নেয়।

আবহাওয়াবিদ ড. আবদুল মান্নান আরও বলেন, তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা পেয়েছি, নেত্রকোনা, নরসিংদী, কুমিল্লা- দেশের এ মধ্যাঞ্চল বজ্রপাতের হটস্পট। বজ্রপাতের অনুকূল পরিবেশের মধ্যে এ অঞ্চলে সামপ্রতিক সময়ে বেশি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। বজ্রপাতের এ দুর্যোগে প্রাণহানি ও আহত হওয়া ঠেকাতে মানুষের সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। রোববারের ঝড়-বৃষ্টির বিষয়ে তিনি বলেন, রোববারের বজ্রপাতের পর কয়েকদফা বৃষ্টিও হয়েছে, রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেছে। পরপর বজ্রপাত ঘটছে, মানুষেরও কিছু করার থাকে না। সচেতন না হলে আবহাওয়াগত এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক জানান, বজ্রপাত নিরোধক ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ স্থাপন করার পাশাপাশি ‘আর্লিওয়ার্নিংয়ের’ সর্বশেষ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে প্রচেষ্টা রয়েছে। তিনি জানান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে সাত-আটটি জায়গায় বজ্রপাত ডিটেকটিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত হচ্ছে। আগাম বার্তা দেয়ার বিষয়টি আমাদের প্রজেক্টেও যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নেয়া হয়েছে। চলনবিল ও বরেন্দ্র এলাকায় বজ্রপাত নিরোধক স্থাপনা করা হবে।

খোলা জায়গায় উঁচু গাছ থাকলে তাতে বজ্রপাতবাহিত হয়ে তা ভূমি স্পর্শ করবে। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারকেল গাছ রোপণ করার উদ্যোগও রয়েছে সরকারের।

এদিকে ব্যাংককের রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেমের জলবায়ু ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহন কুমার দাশ জানান, বজ্রপাতের বিষয়ে আগাম পূর্বাভাসের অভাব ও মানুষের অসচেতনতার কারণে হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। বজ্রঝড়ের সময় সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বজ্রপাতের ভয় থাকে। কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত শুরুর অন্তত আধ ঘণ্টা সময় সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে মে মাসে একদিনে ৩৩ জনের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। পাঁচ বছর আগে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে সরকার।

গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে বজ্রপাত নিয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডার অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেল বলছে, লকডাউনের মধ্যে ৬ জুন একদিনেই অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে। বরাবরের মতো কৃষকের সংখ্যাই বেশি, তারপর জেলে এবং ছাদে-মাঠে খেলারত শিশু। ঘরের মধ্যে থাকার কথা থাকলেও অসচেতনতার কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে।

জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, বজ্রপাত প্রতিরোধে সারা দেশে এক কোটি তালগাছ রোপণের প্রকল্প ছিলো, তার মধ্যে ৩৮ লাখ গাছ লাগানো হয়েছে। এখন বন্ধ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে চলতি অর্থবছরেই আবার চালু হবে। এছাড়া সিগন্যালিং ব্যবস্থার চালু করা হচ্ছে, যা নিয়ে ঢাবির একজন অধ্যাপকও বলেছিলেন তিন ঘণ্টা আগে জানানো যাবে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় এগুলো বসানো হবে। এছাড়া লাইটনিং অ্যারেস্টারও স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে সাপ্লায়ারের সঙ্গেও কথা হয়েছে। হাওর এলাকায় শেল্টার ছাউনি বসানো হবে, যেখানে বজ্রঝড়ের সময় মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে বলেও জানান তিনি।

আমারসংবাদ/জেআই