Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার

মো. আকতারুল ইসলাম

জুন ১১, ২০২১, ০৫:৫০ পিএম


শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার
  • জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমসহ সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজির সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প-২০৪১ এর আগেই শিশুশ্রম মুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে এবং এবারের প্রতিপাদ্য সার্থকতা পাবে

সব শিশু শিক্ষা লাভ করুক, সব শিশু শৈশবকে উপভোগ করুক। শিশুটি মানুষের মতো মানুষ হোক— এটি প্রতিটি বাবা-মার চিরন্তন স্বপ্ন। বাস্তবতার নির্মমতায় সব বাবা-মার এ স্বপ্নটি ডানা মেলে না। জীবনের প্রয়োজনে, সংসারের তাগিদে বয়স ১৪ না পেরুতেই হয়তো বাবা-মার আদরের শিশুটি আজ শ্রমে নিয়োজিত। সমাজে এমন শিশুর সংখ্যা খুব কম হলেও প্রতিটি শিশুকে সুস্থ পরিবেশে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিতে, তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফসহ বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা যৌথভাবে দিবসটি উদযাপন করছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের আহ্বান, শিশুশ্রমের অবসান’। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম নিরসন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আইএলও ১৯৯২ সালে প্রথম শিশুশ্রমের জন্য প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে আইএলও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবছর দিবসটি শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা সোনার বাংলা গড়তে বাঙালির জীবনমানের উন্নয়ন, কর্মের স্থিতিশীলতা, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন টেকসই করার জন্য শিল্প-কারখানাগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করেন। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ এবং অধিকার সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওতে যোগ দেন এবং জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আইএলওর সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালেই শিশু নীতি প্রণয়ন করেন। তাইতো জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে শিশুশ্রম অবসানের আহ্বানে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ অনেক আগেই নিকৃষ্ট ধরনের শিশুশ্রম নিরসন সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন-১৮২ অনুসমর্থন করেছে। ওই কনভেনশনের বিধান দফা-৪ এ বলা হয়েছে অনুসমর্থনকারী দেশ সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক সংশোধনসমূহের সাথে আলোচনাক্রমে শিশুদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা কিংবা নৈতিকতার পক্ষে হানিকর কাজের তালিকা ও সময় নির্ধারণ করবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পক্ষে অন্তরায়, এমন কাজের তালিকা প্রণয়ের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের ২০০৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ৩৪ লাখ শিশুশ্রমে নিযুক্ত। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প গ্রহণ, বাবা-মা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে পরের ১০ বছরে শিশুশ্রমের সংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। ২০১৩ সালের বিবিএস জরিপে দেখা যায়, শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখ। শ্রম মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করে এবং ২০১৩ সালে অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরি, অটোমোবাইল ওয়ার্কসপ, ব্যাটারি রি-চার্জিং, বিড়ি ও সিগারেট তৈরি, ইট বা পাথর ভাঙা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ বা লেদ মেশিন, কাচ বা কাচের সামগ্রী তৈরি, ম্যাচ তৈরি, প্লাস্টিক বা রাবার সামগ্রী তৈরি, লবণ তৈরি, সাবান বা ডিটারজেন্ট তৈরি, স্টিল ফার্নিচার বা গাড়ি বা মেটাল ফার্নিচার রং করা, চামড়াজাত দ্রব্যাদি তৈরি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার, কাপড়ের রং ও ব্লিচ করা, জাহাজ ভাঙা, চামড়ার জুতা তৈরি, ভলকানাইজিং, মেটাল কারখানা, জিআই শিট বা চুনাপাথর বা চক সামগ্রীর কাজ, স্পিরিট বা অ্যালকোহলজাত দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াকরণ, জর্দা ও তামাক বাকুইবাম তৈরি, কীটনাশক তৈরি, স্টিল বা মেটাল কারখানা, আতশবাজি তৈরি, সোনার সামগ্রী বা ইমিটেশন বা চুড়ি তৈরির কাজ, ট্রাক বা টেম্পো বা বাস হেলপার, স্টেইনলেস স্টিল সামগ্রী তৈরি, ববিন ফ্যাক্টরিতে কাজ, তাঁতের কাজ, ইলেকট্রিক মেশিনের কাজ, বিসু্কট বা বেকারির কাজ, সিরামিক কারখানার কাজ, নির্মাণকাজ, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে কাজ, কসাইয়ের কাজ, কামারের কাজ এবং বন্দরে মালামাল হ্যান্ডলিংয়ের কাজ— এই ৩৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

-২-

বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না, তবে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এমন হালকা কাজ করতে পারবে। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুশ্রমের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। শিশুশ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২২টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ গঠন, বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসক এবং উপজেলাপর্যায়ে ইউএনওদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিগুলো শিশুশ্রম নিরসনে সামাজিক আন্দোলন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। মাঠপর্যায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কল-কারখানায় শিশুশ্রমের বিষয়টিকে শ্রম পরিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের মাধ্যমে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, বিভাগীয় এবং জেলাপর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠান এবং শ্রম পরির্দশনের কারণে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে আটটি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছরই আরও কয়েকটি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম মুক্ত ঘোষণা করা হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার। এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা সবার সহযোগিতায় কলকারখানায় উৎপাদন সচল রেখে চলমান করোনা মহামারি সক্ষমতার সঙ্গে মোকাবিলা করছি। আমরা দুস্থ, সুবিধাবঞ্চিত ও কর্মহীন হয়ে যাওয়া মানুষের জন্য বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদান করছি। এর মাধ্যমে শ্রমে নিয়োজিত শিশুরাও উপকৃত হচ্ছে। শিশুশ্রম সম্পর্কিত আইএলওর কনভেনশন শিশুশ্রম নিরসনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। শিশুশ্রম নিরসনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণে ইতোমধ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের লক্ষ্যে জাতীয় জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শিশুশ্রম নিরসনে যথাযথ ও টেকসই কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আমাদের অদৃশ্য শত্রু করোনা মহামারিকে পরাজিত করে সকলের সহযোগিতায় এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে আমরা সফল হবোই।

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কার্যক্রম বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে এ প্রকল্পের তিনটি পর্যায়ে ৯০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চতুর্থপর্যায়ে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনা হবে। তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী শিক্ষা দেয়া হবে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এসময়ে শিশুর বাবা-মাকে মাসিক সম্মানি দেয়া হবে। সাথে সাথে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি করা হবে। শিশুশ্রম নিরসন নীতির আলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ১০টি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

আশা করা যায়, জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমসহ সকল প্রকার শিশুশ্রমের অবসান ঘটবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজির সফলতার সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প-২০৪১ এর আগেই শিশুশ্রম মুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে এবং এবারের প্রতিপাদ্য সার্থকতা পাবে।

লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই