Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আদালতে ঘুরছেন ১০ বছর!

জুন ১৪, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


আদালতে ঘুরছেন ১০ বছর!
  • বিচারকশূন্যতা, সমন জারি ও মালিক-শ্রমিকদের অনুপস্থিতিতে ঝুলে আছে মামলা
  • ৬৩ লাখ শ্রমিকের বিপরীতে বিচারক মাত্র একজন
  • মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা
  • মামলা নয়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
  • ১০ আদালতে বিচারাধীন সাড়ে ১৬ হাজার মামলা

কর্মক্ষেত্রে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। প্রতিনিয়তই এমন খবর প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। নানা সময়ে ন্যায্য পাওনা আর কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য অগণিত শ্রমিক রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তারপরও দেশের লাখ লাখ শ্রমিক প্রতিনিয়ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথ মজুরি না দেয়া, বাসস্থান, পরিবহন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকা, সাপ্তাহিক ছুটি না দেয়া, বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত সময় কাজ করানো ও মাতৃত্বকালীন ছুটি না দেয়া একটি নিয়মিত সমস্যা। এসব সমস্যার প্রতিকার চেয়ে ভুক্তভোগীরা শ্রম আদালতের দারস্থ হন। তবে শ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। শ্রম আইন শ্রমিকবান্ধব নয় এমন অভিযোগেও সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে শ্রমিক সংগঠনগুলো। আবার সুরক্ষা আইনে মামলা হলেও বিচার পেতে কেটে যায় বছরের পর বছর।

আদালত সূত্র জানায়, প্রায় সব আদালতেই কিছুদিন পরপর বিচারকশূন্য থাকায় মামলাজট বেড়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে রেজিস্ট্রারও নেই। অফিস সহকারী, নিরাপত্তারক্ষীসহ জনবল সংকটের কারণেও যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। নিষ্পত্তি না হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে মামলাজট। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শ্রমিকদের। জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারকের অভাবে বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে রয়েছে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে শ্রম আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের ভোগান্তি বেড়েছে আরও বহুগুণ। এর মধ্যে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদও শূন্য কয়েক মাস ধরে। এদিকে  শ্রম আইনের ২১৬ ধারায় মামলা দায়েরের ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও তা উপেক্ষিত হাচ্ছে বারবার। যেনো দেখার কেউ নেই। ফলে দায়েরকৃত মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় আইনি লড়াই করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ভুক্তভোগী শ্রমিকরা। বিচারের আশা ছেড়ে আদালতে আসাই বন্ধ করেছেন কেউ কেউ। একপর্যায়ে মামলাও খারিজ হয়ে যাচ্ছে। পার পেয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী মালিকপক্ষ।

এমনই একজন ভুক্তভোগী মৌলভীবাজারের রাজনগর টি-অ্যাস্টেট লিমিটেডের শ্রমিক দীপ চান। চাকরিচ্যুতির পর পুনর্বহাল ও বকেয়া চেয়ে চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন ২০১১ সালে। সেই মামলা এখনো ঝুলে আছে। সিলেট-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়ায় ক্লান্ত তিনি। দীপ চান বলেন, ‘এখন আর চট্টগ্রাম আসি না। বিচারের আশাও করি না।’

২০১৬ সালে আশুলিয়ার মাহবুব অ্যাপারেলসের ১০০ জন শ্রমিককে বিনা নোটিসে বেতন-ভাতা না দিয়েই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কারখানার অপারেটর ইমদাদুল, রাজু, সম্রাটসহ ৪০ জন শ্রমিক তাদের আইনানুগ পাওনাদির জন্য মামলা করেন ঢাকার শ্রম আদালতে। কিন্তু আজও সেই মামলার সুরাহা হয়নি। বরং এখন বাদিদের অনেকেরই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিচারকশূন্যতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, সমন জারিতে দেরি, জবাব দাখিলে আইনজীবীদের বারবার সময় নেয়া, প্রতিনিধিদের মতামত দিতে দেরির কারণে শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মামলার বিচার ঝুলে আছে। আইনজীবীরা আরও জানান, শ্রম আদালতে মামলা করার ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় পাওয়া যাবে। শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় ঢাকায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যায়। শ্রম আদালতের স্বল্পতার কথা বলছেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞরাও। শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, ‘দেশে প্রতিদিন যেখানে শতশত শ্রমিক বাড়ছে সেখানে আগের মতো সাতটি থেকে বর্তমানে ১০টি শ্রম আদালত যথেষ্ট নয়। এ জন্য মামলাজট লেগেই থাকে। গুরুত্বপূর্ণ সব জেলায় দ্রুত শ্রম আদালত করা উচিত। তবে নতুন করে ময়মনসিংহ, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি শ্রম আদালত গড়ে তোলা হচ্ছে। আশা করছি সঙ্কট কিছুটা হলেও কমে আসবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে ১০টি শ্রম আদালতে বিচার চললেও তা যথেষ্ট নয়। মামলা অনুপাতে শ্রম আদালতের সংখ্যা ও লোকবল বাড়েনি। ১০টি ট্রাইব্যুনালে যে মামলার রায় ও আদেশ হয়, তার বিরুদ্ধে আপিলের জন্য দেশে মাত্র একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, যেটি ঢাকায় অবস্থিত। ফলে অনেক শ্রমিকই ঢাকায় এসে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে উৎসাহী হন না। আবার মামলাজটের কারণেও শ্রম আদালতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিকদের। একইভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখে। এতেও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয় এবং শ্রমিকরা দ্রুত ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি ৩৫ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক শ্রম জনগোষ্ঠীর জন্য দেশের ১০টি শ্রম আদালতে বিচারক আছেন ১০ জন। সে ক্ষেত্রে বিচারকের সংখ্যা শ্রমিক সংখ্যার অনুপাতে একজন বিচারকের বিপরীতে শ্রমিকের সংখ্যা ৬৩ লাখ। অর্থাৎ ৬৩ লাখ শ্রমিকের জন্য মাত্র একজন বিচারক। ফলে বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে শ্রমিকদের মামলা। শ্রম আদালতের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের সাতটি শ্রম আদালতে প্রায় ১৬ হাজার  ১১৫টি মামলা ঝুলছে। এর মধ্যে গত চার বছরে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় আট হাজার। ২০১৭ সালের এপ্রিলে দেশের ১০টি শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ছিলো ১৬ হাজার ১১৫টি মামলা। অথচ এখন সেই আদালতগুলোতেই গত জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে ২৩ হাজার ৪১৫টি মামলা। এর মধ্যে ঢাকার তিনটি আদালতে যথাক্রমে ছয় হাজার ৬৮৫, সাত হাজার ৫৩৪ ও চার হাজার ৬৮৩, চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালতে এখন দুই হাজার ৫৪৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে প্রথম শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে এক হাজার ৮৫৮টি এবং দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৬৮৯টি। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি মামলা রয়েছে, যেগুলো ছয় থেকে আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি আদালতে এক বছরে (গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত) নিষ্পত্তি হয়েছে ২২৭টি। এর আগের বছর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৫০টি। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলা নিষ্পত্তিতে এবার সময় লাগছে বলে জানান শ্রমিক ও আইনজীবীরা। রংপুরে ১৪৩, সিলেটে ৫৩ এবং বরিশালে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে এক হাজার ২৪৯টি মামলা। তবে ২০১৯ সালে সরকার এক প্রজ্ঞাপন জারি করে মৌলভীবাজার ও সিলেটে শ্রম আদালত চালুর ঘোষণা দেয়। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এর  কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে বিভিন্ন চাকরিজনিত সমস্যার মামলায় সিলেট বিভাগের শ্রমিকদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে।

জানতে চাইলে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘পর্যাপ্ত আদালত ও বিচারক না থাকার কারণে শ্রমিকদের মামলাগুলো ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। এতে করে শ্রমিকরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। আর এখন তো করোনার কারণে শ্রম আদালতের কার্যক্রমই বন্ধ।’

শ্রম আদালতের মামলাজট কমাতে সেক্টর অনুযায়ী পৃথক কমিটি গঠনই কার্যকর বলে মনে করছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘শ্রম আদালতে মামলা করতে গেলে শ্রমিককে নানা হয়রানির মুখোমখি হতে হয়। কারণ পদ্ধতিটাই জটিল। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শ্রমিককে আইনজীবী অনুসরণ করতে হয় এবং আইন অনুসারে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এটি শ্রমিকের জন্য ব্যয়বহুলও। এ জন্য শ্রমিকরা সাধারণত আদালতে যেতে চান না।

তার মতে, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় আইন সংশোধন করে দুটি ধাপ করা যেতে পারে। প্রথম ধাপে প্রতিটি সেক্টর অনুসারে একটি কমটি গঠন করা যেতে পারে। সেখানে অভিযোগ দেয়ার পর উভয় পক্ষের শ্রমিক ও মালিক অথবা সংশ্লিষ্টদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটি-দুটি শুনানির মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায়। আর দ্বিতীয় ধাপে শ্রম আদালত ট্রেড ইউনিয়নের রাইটস, আর্থিক ক্ষতিপূরণ, অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিষ্পত্তি করবে। এতে শ্রমিকের বেতন বা আর্থিক সুবিধা, গ্রাচ্যুইটিসহ ছোটখাটো বিরোধগুলো আদালতের বাইরে নিরসন করা সম্ভব হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশেই শ্রমিক স্বার্থে এমন বিধান রয়েছে। এতে খরচ ও সময় দুটোই কম লাগে।’

শ্রমিকদের পাওনাসহ নানা দাবি সহজে আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল ফারুক। তিনি বলেন, ‘এতে সময় কম লাগবে। দুর্ভোগ কম হবে। মালিক-শ্রমিক দুজনই উপকৃত হবে। দেশে বিচারক সংকটসহ নানা কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়ে যায়। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক।

আমারসংবাদ/জেআই