সোলেমান খান
জুন ১৪, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম
গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছে। করোনা নামক মহামারির মধ্যে এই দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিলো ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই যৌক্তিক বলেই বিবেচিত হয়েছে।
গ্লোবাল ওয়ার্নিং ও বায়ুদূষণের ফলে বাস্তুতন্ত্র প্রভাবিত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে, গাছপালা ও পশুপাখির ওপর। একটি সুস্থ পরিবেশে গাছপালা ও পশুপাখির সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের যোগাযোগ স্থাপন প্রয়োজনীয়। মানুষ এখন বুঝতে পারছে প্রকৃতিগত উৎসসমূহকে ধ্বংস করে নগরায়ণ আমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে গেছে। পরিবেশকে তার সঠিক অবস্থানে না রেখে আমাদের উন্নয়ন কতটা আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকলে আগামী প্রজন্ম সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে। এমনটাই প্রত্যাশা করছেন পরিবেশবাদীরা। ১৯৬৮ সালের ২০ মে সুইডেন সরকার জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানান। সেই বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে এ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। এর সমাধানের লক্ষে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সম্মতিতে সুইডেনের স্টকহোমে ‘জাতিসংঘের মানব পরিবেশ সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনটি পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিবসটি পালন করা হয়। তবে বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে এক সময় বর্ষাকালেই ছিলো গ্রামীণ জনপদে প্রাণচাঞ্চল্যতা। নদীদখল, জলাশয়, পুকুর, খাল-বিল, হূদ সবকিছু ভরাট করে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা ও নগরসভ্যতা। আবার একটু বৃষ্টি হলেই নগরে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের হাজার বছরের লালিত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
অন্যদিকে পাহাড় কেটে আবাসস্থল, শহর, শপিংমল তৈরি এ যেনো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। সেখানেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পাহাড় কেটে আবাস নির্মাণের ফলে দেশের পাহাড়ি এলাকা বৃষ্টি, অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা কারো অজানা নয়। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশ এখন ৭২ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ভূমিক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছে। দেশে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে গেছে।
বাংলাদেশের বনভূমির অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিভিন্ন সংস্থার মতে, বনভূমির পরিমাণ প্রায় সাত ভাগ কিন্তু থাকা দরকার কমপক্ষে ১৫ ভাগ। বনভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে, উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বনশূন্য হয়ে পড়বে। বন্যপ্রাণীরা এখন হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয়। কিন্তু অনেক প্রাকৃতিক প্রজাতির মাছ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ইত্যাদি দূষণ ও দখল রোধ করা না গেলে প্রাকৃতিক প্রজাতির মাছ রক্ষা করা যাবে না।
জ্বালানি হিসেবে বন উজাড় হচ্ছে। এতে বায়ুদূষণ হচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে জৈবসার ব্যবহার অপরিহার্য। সরকারের জৈব কৃষিনীতি থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দেশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ইত্যাদি নদীর পানি দূষণ হচ্ছে। এসব নদী থেকে মৎস্যচাষিরা এখন মৎস্য আহরণ করতে পারছে না। মৎস্যজীবীরা পেশা বদল করছে। বিশেষ করে যেসব মৎস্যজীবী নদী, জলাশয়, খাল-বিল থেকে মৎস্য আহরণ করতো সে সব মৎস্যজীবীর সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। কলকারখানা ও টেনারির বর্জ্যে নদীতে প্রাকৃতিক মাছের সংকট লেগেই আছে। দেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের ফলে পরিবেশ মারাত্মক দূষণ হচ্ছে ।
সুন্দরবন আমাদের দেশের অহংকার। প্রচুর বনজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার এই বনাঞ্চল। কিন্তু রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। এর জীববৈচিত্র্য, বনজ সম্পদ হারিয়ে যাবে এই বৈদ্যুতিক প্লান্ট নির্মাণের ফলে।
দেশের প্রাকৃতিক রিসোর্সকে ধ্বংস করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের নদ-নদী, জলাশয়, বনভূমি, পাহাড়-টিলা সবকিছু অক্ষত রেখে আমাদের উন্নয়নের গতিধারা ঠিক রাখতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশ যেমন নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ আছে যারা প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষত রেখে উন্নতির শেখড়ে নিজেদের উপস্থাপন করেছে। সুতরাং আমরা কেন পারবো না?
বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগাম এলাকায় আশ্রয় দেয়ায় সেখানে পাহাড়ি এলাকার বিস্তীর্ণ ভূমি কেটে আশ্রয়কেন্দ্র করায় সেখানে পাহাড়ের বিপর্যয় ঘটেছে। অন্যদিকে বনাঞ্চল লোপাট হয়ে গেছে। সুদূর অতীতে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জের ভারত সীমান্ত অঞ্চলের পাহাড় ও বনজসম্পদ যে পরিমাণ ছিলো এখন তা আর নেই। টাঙ্গাইল, জামালপুর এলাকায়ও একই অবস্থা। বিভিন্ন স্থানে নদী-খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের খালগুলো ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করার ফলে পরিবেশ নষ্ট হয়ে দেশি ছোট মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলো বিনষ্ট হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ সুরক্ষায় আন্তরিক। তিনি বিশ্বের জলবায়ু সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যুগান্তকারী বক্তব্য ও প্রস্তাবনা রেখে সাড়া বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাবে সরকারের গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে কৃষিজমিতে ইটের ভাটার হিড়িক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এছাড়া কৃষিজমির উর্বর মাটিগুলো ইটের ভাটায় কাজে লাগায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে ফসল ফলাতে ওইসব জমিতে কৃত্রিম সার ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন ও ভরাট মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ সমস্ত কাজে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত করেন মুখ চেয়ে চেয়ে। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মাঠের কর্মকর্তারাও ভীতসন্ত্রস্ত।
আমাদের জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষায় অবশ্যই দেশের বনভূমি ২৫ ভাগে উন্নীত করতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয় থাকা জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবেশ রক্ষায় যেসব নীতিমালা রয়েছে এসবের বাস্তবায়ন জরুরি। আমাদের সড়ক ও রেলপথে চাপ কমাতে হবে। নদীগুলোকে ড্রেজিং করে অচল অবস্থাকে সচল করতে হবে। নদীপথে পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নীত করা প্রয়োজন। বর্তমানে পরিবেশের ওপর অত্যাচারের কারণেই পরিবেশ কখনো কখনো আস্ফাালন দেখাচ্ছে। এতে মানবসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অতিরোদ, খরা, তাপদাহ আমাদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে দিচ্ছে। তাই সবাইকে নদীর কান্না, পাহাড়ের কান্না বুঝতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য সুখী ও সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সুরক্ষা অন্যতম শর্ত। তাহলেই আমরা স্বস্তি ও শান্তি পাবো।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আমারসংবাদ/জেআই