Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

হাদিসের মহান সাধক ইমাম বুখারি র.

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জুন ১৭, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


হাদিসের মহান সাধক ইমাম বুখারি র.

হাদিসের এক মহান সাধকের নাম ইমাম বুখারী (র.)। তাঁর নাম মুহাম্মদ। উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীস তাঁর উপাধি। বুখারা তাঁর জন্মস্থান বলে তাকে বুখারী বলা হয়। ইমাম বুখারীর (র) পূর্ণনাম- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারী (র)। তিনি ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার, ১৯৪ হিজরিতে (৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) খোরাসানের বুখারাতে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম। দাদার নাম ইব্রাহিম। দাদা সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও বাবা ইসমাইল মুসলিম বিশ্বে একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হাদীসবিদ। তিনি হাদীস শাস্ত্রবিদ আল্লামা হাম্মাদ (র.) এবং হযরত ইমাম মালেকের (র) শাগরিদ ছিলেন। এছাড়াও বিখ্যাত মনীষী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের (র) শাগরিদ ছিলেন বলে জানা যায়। সমসাময়িক যুগের আরও অনেক বুজুর্গ আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনের জাহেরি ও বাতেনি ইলম হাসিল করে সুযোগ্য আলেম ও বিজ্ঞ মুহাদ্দিস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইমাম বুখারী (র) শিক্ষা, জ্ঞান ও যোগ্যতা শুধু পিতার দিক থেকেই পাননি; বরং মাতার দিক থেকেও অর্জন করেছিলেন। ইমাম বুখারীর (র) মাতা ছিলেন বিদূষী ও মহীয়সী মহিলা। নেককার মহিলা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। এ সম্পর্কে একটা ঘটনা আছে। বাল্যকালে ইমাম বুখারী (র) একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ রোগের প্রভাবে তার দুই চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। স্নেহময়ী মাতা পুত্রের চোখের আলোর পুনঃপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং মহান আল্লাহ্ পাকের দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক রাত্রে স্বপ্নে তিনি হযরত ইবরাহিমকে (আ) তাঁর শিয়রে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত ইবরাহিম (আ) তাকে বলেন, তোমার প্রার্থনা আল্লাহ্ পাক কবুল করেছেন। তাঁর দয়ার বরকতে তোমার পুত্র চোখের আলো ফিরে পেয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে তার পুত্র ইমাম বুখারী (র.) বলে উঠলেন, আম্মা! আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ ভালো হয়ে গেছে। এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে ইমাম বুখারীর (র) মাতা অনেক বড় মাপের বুজুর্গ মহিলা ছিলেন। ইমাম বুখারী (র) শৈশবেই বাবাকে হারান, ফলে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। পিতা মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধনসম্পদ রেখে যান। ফলে ইমাম বুখারীকে (র) কোনোরূপ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। মাতাই পুত্রের শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন। ইমাম বুখারীর (র) বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। ইমাম বুখারী (র) প্রথমে কুরআন শিক্ষা শুরু করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্থ করা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি “আবদুল্লাহ বিন মুবারক” এবং “ওয়াকীর পা্লুলিপিসমূহ” মুখস্থ করে ফেলেন। মহান আল্লাহ্ পাক তাকে অনন্য সাধারণ স্মরণ শক্তি দান করেছিলেন।

ইমাম বুখারীর (র.) স্মরণ শক্তির প্রখরতা : ১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেয ছিলেন। যে কোনো কিতাবে একবার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তা মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন। একদা ইমাম দাখেলি (র) একটি হাদিসের সনদ বর্ণনা করার সময় ‘জুবাইর’ -এর স্থলে ‘আবু জুবাইর’ বলেছেন। ইমাম বুখারী নম্রস্বরে বললেন- এখানে আবু জুবাইর’ -এর স্থলে ‘জুবাইর’ হবে। অতঃপর ইমাম দাখেলি (র) বাড়িতে গিয়ে কিতাব দেখে তার ভুল সংশোধন করেছেন। এর অব্যবহিত পরই দাখেলি (র) তাকে খুব স্নেহ করতেন। দরস চলাকালে উনার সহপাঠীগণ হাদীসগুলো লিখে নিতেন। তিনি তা লিখতেন না। তার সহপাঠীগণ তাকে হাদীস না লিখে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেননি। অতঃপর সহপাঠীগণ তাকে হাদীস লেখার জন্য জোর তাগিদ দিলে তিনি উত্তর দিলেন- “আপনাদের লেখা কপিগুলো নিয়ে আসুন। তারা কপিগুলো নিয়ে আসলে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাদের সামনে হাদীসগুলো পাঠ করে শোনান। সেই মজলিসে তাদের লেখা অনুসারে প্রায় পনের হাজার (১৫,০০০) হাদীস মুখস্থ পাঠ করে শোনান। ইমাম বুখারী (র) বলেন, আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীস ও দুই লক্ষ যঈফ হাদীস মুখস্থ রয়েছে। মুহাদ্দিস ইবনে খুযায়মা (র) বলেন, পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীসের হাফেয আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেননি।

ইমাম বুখারীর (র.) অমূল্য সৃষ্টি সহিহ বুখারী: ইমাম বুখারী রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। এগুলোর কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। আর কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার রচিত গ্রন্থাবলির মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো সহিহ বুখারী।  ইমাম বুখারীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম হচ্ছে এই হাদীসগ্রন্থের রচনা। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াই থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন। একদিন ইসহাক এমন একটি গ্রন্থের আশা প্রকাশ করেন, যাতে লিপিবদ্ধ থাকবে শুধু সহিহ হাদীস। ছাত্রদের মাঝে ইমাম বুখারী তখন এই কঠিন কাজে অগ্রসর হন। ২১৭ হিজরি সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মক্কার হারাম শরীফে এই গ্রন্থের সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরি সনে এর সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়। বুখারী শরীফের সংকলনকালে তিনি সর্বদা রোযা রাখতেন এবং প্রতিটি হাদীস সন্নিবেশিত করার আগে গোসল করে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে মুরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। এই গ্রন্থে তিনি সকল সহীহ হাদীস সংকলন করেননি; বরং সহীহ হাদীসের মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে, সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি স্বয়ং বলেন, “আমি জামে কিতাবে সহীহ হাদীস ব্যতিত অন্যকোনো হাদীস উল্লেখ করিনি। তবে কলেবর বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক সহীহ হাদীসকে বাদ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি আমার কিতাবে প্রতিটি হাদীস লেখার পূর্বেই গোসল করেছি এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করেছি। অপর বর্ণনা হতে জানা যায় যে, ইমাম বুখারী (র) তাঁর স্বীয় কিতাবের শিরোনামসমূহ রাসুলের (স) রওজা এবং মসজিদে নববীর মধ্যস্থলে বসে লিখেছিলেন এবং প্রত্যেক শিরোনামের জন্য দুরাকাত নফল নামাজ আদায় করেছেন। ইমাম বুখারীর প্রায় ৬ লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। বুখারী শরীফের পুরো নাম হলো-  আল জামি আস সহীহ আল মুসনাদ মিন উমুরি রাসুলিল্লাহ (স) ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি। ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, আমি আমার সহীহ বুখারী সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়নের কাজ শেষ করি। আর প্রতি বছরই হজ্জ পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি। তিনি ৬ লাখ হাদীস হতে যাচাই বাছাই করে সর্বসাকুল্যে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিদ্ধ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। এখানে মোট হাদীস আছে সাত হাজার একশত পঁচাত্তর খানি (৭,১৭৫)। আর পুনরুক্ত ছাড়া আছে প্রায় চার হাজারের (৪,০০০)। আর কারো মতে, বুখারীতে পুনরুক্ত হাদীস আছে মাত্র একখানি যা রুমালের বর্ণনা।বিশ্বের সকল মুসলমানদের কাছে পবিত্র আল কুরআনের পরেই সহীহ বুখারী সর্বাধিক পবিত্র গ্রন্থ।

ইমাম বুখারীর শেষ জীবন ও মৃত্যু: ইমাম বুখারীর শেষ জীবন খুব সুখ-শান্তিতে অতিবাহিত হয়নি। যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসাবে যখন ইমাম বুখারীর সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তখন বুখারার আমির স্বীয় ইমাম বুখারীকে রাজ দরবারে এসে সন্তানদেরকে সহীহ বুখারী পড়ানোর জন্য প্রস্তাব করলো। ইমাম বুখারী তার মসজিদ ও সাধারণ লোকদেরকে ছেড়ে দিয়ে রাজ দরবারে গিয়ে আলাদাভাবে আমিরের ছেলেদেরকে বুখারী পড়ানোকে ইলমে হাদীসের জন্য বিরাট অবমাননাকর ভেবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি পরিষ্কার বললেন, আমির যদি সত্যিকার অর্থে ইলমে হাদীসের প্রতি অনুরাগী হন, তাহলে তিনি যেন তার সন্তানদেরকে আমার পাঠ্যস্থান মসজিদে পাঠান। এতে আমির ইমাম বুখারীর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন এবং বুখারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য আমিরের নিজস্ব কিছু আলেম ঠিক করলেন। আমিরের আদেশ এবং ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে তিনি জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে চলে যান। নিশাপুরেও অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে পরিশেষে সমরকন্দের খরতঙ্গ নামক স্থানে চলে যান। বুখারা থেকে বের হওয়ার সময় ইমাম আল্লাহর কাছে এই দুআ করেন যে, হে আল্লাহ্! সে আমাকে যেভাবে অপমান করে বের করে দিলো তুমিও তাকে অনুরূপ লাঞ্চিত করো। মাত্র এক মাস পার হওয়ার পূর্বেই খুরাসানের আমির খালেদ বিন আহমাদের বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতা ছাড়া করলো। পরবর্তীতে  ২৫৬ হিজরির, ১লা শাওয়াল মোতাবেক ৩১শে আগস্ট, ৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের শুক্রবার দিবাগত রাতে বাগদাদের জেলে থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন শনিবার যোহরের নামাজের পর খরতঙ্গেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর পর তার কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হয়। লোকেরা দলে দলে তার কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনোভাবে তা নিবৃত্ত করতে না পেরে কাঁটা দিয়ে ঘিরে তার কবর রক্ষা করা হয়। পরে জনৈক অলেম মানুষের আকিদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সে ঘ্রাণ বন্ধ করার জন্য দুআ করেন, ফলে তা আল্লাহর রহমতে বন্ধ হয়ে যায়।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই