Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ

জুন ১৮, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ
  • চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত গরু ছাগল রয়েছে
  • বড় চাহিদা পূরণ হবে চরাঞ্চলের ছাগলে
  • দেশে পশু এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার
  • গত বছরের তুলনায় ১৯ হাজার বেশি
  • ভারত থেকে কোনোভাবেই পশু আসবে না
  • ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পশু রপ্তানি প্রস্তাবও নাকচ

দেশি গরুতেই এবার হবে কোরবানি। চাহিদার চেয়েও রয়েছে পর্যাপ্ত মজুত। দেশীয় পশুর উৎপাদন বাড়ায় গরু, ছাগল ও মহিষে চাহিদার সবটুকুই পূরণ সম্ভব হবে। খামার মালিকদের প্রণোদনা প্রদান এবং সরকারি নীতিগত সহায়তা অব্যাহত থাকায় গবাদিপশুতে বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এবার কোরবানিতে গবাদিপশু সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই বলে দাবি করেছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। চলতি বছর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সীমান্ত এলাকা। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ কোনোভাবেই গরু আসতে দেয়া হবে না। পৃথিবীর শীর্ষ মাংস উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার গরু রপ্তানির প্রস্তাবও এ কারণে নাকচ করে দিয়েছে সরকার। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর ভারতের বয়স্ক বুড়ো গরুতে বাজার দখল থাকে। এবার আর সেটির সুযোগ নেই। সরকারের ঘোষণায় কার্যত স্বস্তিতে দেশের মানুষ।

তথ্যমতে, শুধু কোরবানি ঈদের আগে দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ গরু, ছাগল বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসতো। এর মধ্যে বেশির ভাগ পশু আনা হতো ভারত থেকে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে গরু আসতো দেশে।  এ বছর চোরাইপথে কোরবানির পশু কোনোভাবেই যেনো দেশে ঢুকতে না পারে সে জন্য কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। কোরবানিতে ৪৫-৫০ লাখ গরু এবং ৭০-৭৫ লাখ ছাগল ও ভেড়ার চাহিদা রয়েছে। চাহিদার প্রায় সোয়া কোটি পশুর পুরোটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হবে। চাহিদার পর্যাপ্ত পশু নিয়ে প্রস্তুত রয়েছেন খামার মালিকরা। জানা গেছে, এ বছর এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৯ হাজার বেশি। এছাড়া কোরবানির বড় চাহিদা পূরণ হবে চরাঞ্চলের ছাগলে। জানা গেছে, কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু আছে। এ বছর কোরবানিযোগ্য এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি পশু রয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেশি। চলতি বছর হূষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০টি, হূষ্টপুষ্টকৃত ছাগল-ভেড়া ২৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৮টি এবং গৃহপালিত গরু-মহিষের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৮৮ হাজার ২০০টি, গৃহপালিত ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪৯ লাখ ৯২ হাজার ২৫২টি। ঢাকা বিভাগে ৯২ হাজার ৮২১ জন খামারির ছয় লাখ চার হাজার ৬৬৪টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪০ হাজার ৯৬৩ জন খামারির এক লাখ ৬৩ হাজার ৯৪৩টি, খুলনা বিভাগে এক লাখ সাত হাজার ২২৭ জন খামারির আট লাখ ৭৮ হাজার ২৪২টি, রাজশাহী বিভাগে এক লাখ ২৭ হাজার ২৬১ জন খামারির ১৪ লাখ ১০ হাজার ৮০৯টি, রংপুর বিভাগে দুই লাখ ২২ হাজার ৪১৮ জন খামারির ১৩ লাখ তিন হাজার ২৪১টি, সিলেট বিভাগে ১২ হাজার ৯৭২ জন খামারির এক লাখ ৩৮ হাজার ৭২৫টি, বরিশাল বিভাগে ২০ হাজার ৩৮৭ জন খামারির এক লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৪ হাজার ৬৬ জন খামারির ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৫টি হূষ্টপুষ্ট গবাদিপশু রয়েছে।

এছাড়া কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা এবং দুধকুমারসহ ২৬টি নদ-নদীর প্রায় ৪৫০টি চরাঞ্চলে ছাগল পালনের পরিমাণ বেড়েছে। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে দুই জেলায় গরুর সংখ্যা আছে ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০টি আর ছাগল ৬ লাখ ৫৭ হাজার ২৫টি। দুই বছর আগে গরু ছিলো ১৬ লাখ ১২ হাজার এবং ছাগল ছিলো পাঁচ লাখ ৮০হাজার। পশুপালনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ও শক্তিশালী হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কয়েক বছর আগে মাংসের চাহিদা মেটাতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে ৫৫-৬০ হাজার কোটি টাকার গরু ও ফ্রোজেন মাংস আমদানি করা হতো। নিজস্ব উৎপাদন বাড়ায় এখন আর আমদানির তেমন প্রয়োজন হয় না। ফলে আমদানিতে ব্যয়কৃত অর্থের পুরো অংশ দেশেই থাকছে। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কৃষি খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি ও প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বিশেষ করে সরাসরি ফ্রোজেন মাংস ও গরু আমদানি পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করে এর ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপ করা হয়েছে। এতে করে মাংস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের নতুন এই নীতি সহায়তার কারণে দেশীয় খামার বৃদ্ধির পাশাপাশি পশুপালন বাড়বে বলে সমপ্রতি এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। এই খাতে শীর্ষে রয়েছে ভারত ও চীন। বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সামগ্রিকভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন। আর গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। শুধু উৎপাদনের দিক থেকেই নয়, গবাদিপশুর জাতগত বৈচিত্র্যের দিক থেকেও বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী দেশ বলছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থাসহ (এফএও) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ছাগল লালনপালন করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও রাজশাহীতে ২০ হাজার খামারে প্রায় ৫০ লাখ ছাগল পালন করা হচ্ছে।

ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, আমাদের পালিত গরুই চাহিদা পূরণ করতে পারবে। ফলে বাইরের গরু আমদানির প্রয়োজন নেই। কুড়িগ্রাম প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল হাই সরকার বলেন, ‘গরু ও ছাগলের সংখ্যায় যে পরিবর্তন এসেছে তার অধিকাংশই চরাঞ্চলে। ছাগল পালন লাভজনক হওয়ায় চরবাসী সেদিকে ঝুঁকছেন। তাছাড়া, ছাগল পালন করতে খাদ্য কিনতে হয় না। চরাঞ্চলে প্রাকৃতিক ঘাস, লতা-পাতা খাইয়ে ছাগল পালন করা যায়। এ বছর কোরবানির বড় চাহিদা পূরণ হতে পারে চরাঞ্চলে।’

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি মো. শাহ ইমরান বলেন, গবাদিপশু উৎপাদনে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে। এ কারণে আর আমদানির প্রয়োজন নেই। দেশীয় খামারে গবাদিপশু উৎপাদন করা হলেও এগুলো উন্নত বিদেশি জাতের। বকনা বাছুর প্রজননের জন্য বিদেশি উন্নত জাতের ষাঁড়ের সিমেন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে দেশীয়ভাবে লালন পালন করা হলেও মূলত এগুলো বাইরের জাত। তিনি বলেন, উন্নত জাতের হওয়ায় খামারে যেসব গরু ও ছাগল পালন করা হচ্ছে তাতে মাংস হচ্ছে অনেক। পাওয়া যাচ্ছে ভালো দাম। এ কারণে দেশে দ্রুত খামারের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, শুধু কোরবানি নয়, মাংসের জন্য আর বাইরে থেকে গরু আনার প্রয়োজন নেই। পশুপালন ও উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। কোরবানিতে যাতে ভালো দাম পাওয়া যায় সেজন্য পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ এবং হাটগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, ব্যাংকিং সুবিধা নিশ্চিত করা এবং খামারিদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকতে হবে। খামার মালিকরা এখন গরু বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেপারীদের কাছে বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। কোরবানিতে দেশে এবার গরু নিয়ে কোনো সংকট হবে না বলেও জানান এই উদ্যোক্তা।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ কোনোভাবেই গরু আসতে দেয়া হবে না। ঈদ উপলক্ষে ভারত থেকে দেশে বৈধ-অবৈধ পথে অনেক পশু আসে এবং মানুষ যাতায়াত করে। ভারতীয় ভেরিয়েন্ট আমাদের দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এজন্য কোনো অবস্থাতেই যেনো ভারত থেকে বৈধ-অবৈধভাবে মানুষ এবং পশু না আসে সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের শক্ত অবস্থানে থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও কিছু এলাকায় বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় এই ভেরিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। এজন্য পশুরহাট এবং পশু জবাইয়ের নির্ধারিত স্থানেই হাট বসবে। নির্ধারিত স্থানের বাইরে পশু জবাই করতেও দেয়া হবে না।

আমারসংবাদ/জেআই