Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

কুরআন তিলাওয়াতের আদব ও আহকাম

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জুন ২৪, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


কুরআন তিলাওয়াতের আদব ও আহকাম

মহাগ্রন্থ আল কোরআন মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী। কোরআন শব্দের অর্থ যা পাঠ করা হয়, পাঠযোগ্য ও বারবার পাঠের উপযুক্ত। তিলাওয়াত অর্থ পঠন, অধ্যয়ন ও আবৃত্তিকরণ। কোরআন তিলাওয়াত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও বহু তাৎপর্যময় আমল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তুমি বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত করো’ (সুরা মুজজাম্মিল, ৪)। হযরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (স.) কোরআন তিলাওয়াত করতেন প্রতিটি হরফ স্পষ্ট উচ্চারণ করে এবং প্রতিটি আয়াতে বা বাক্যে থেমে থেমে’ (তিরমিজি)।

কোরআন তিলাওয়াতে ও শ্রবণে ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তাদের প্রতি কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ইমান বাড়িয়ে দেয়’ (সুরা আনফাল, ২)। পবিত্র কোরআন তিলওয়াতের কিছু আদব এবং আহকাম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- ১. ইখলাসের সাথে তিলাওয়াত করা: লোকের প্রশংসা ও বাহবা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করা যাবে না এবং একে জীবিকা নির্বাহের উপলক্ষণও বানানো যাবে না। বরং তিলাওয়াত কালে এ অনুভূতি ও আগ্রহ নিয়ে তিলাওয়াত করতে হবে যে, মহান আল্লাহ তায়ালা তার মহান কালামের মাধ্যমে তাকে সম্বোধন করছেন। একাগ্রতা ও চিন্তা গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু সময় কাটানো এবং সুন্দর কণ্ঠের ক্বারীদের মিষ্টি আওয়াজ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করা ও শোনা-কোনটিই উচিত নয়। রাসূল (স.) বলেন: তোমরা কোরআন পড় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর; কারণ ভবিষ্যতে এমন এক সমপ্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা কোরআনের দ্বারা দুনিয়ার সুখ অন্বেষণ করবে। পরকালের সুখ কামনা করবে না, (সুনান আহমদ, ১২১২১)। (২) মিসওয়াক করা: রাসূল (স.) বলেন- মিসওয়াকের মাধ্যমে তোমার স্বীয় মুখ সুগন্ধি যুক্ত কর; কেননা এটি কোরআনের রাস্তা। (৩) পবিত্রতা অর্জন: এটি আল্লাহ তায়ালার কালামের মর্যাদা প্রদান ও সম্মান প্রদর্শন। অপবিত্র অবস্থায় গোসল না করে কোরআন তিলাওয়াত করা যাবে না। পানি না থাকলে বা অসুস্থতা ও এ জাতীয় কোন কারণে ব্যবহারে অক্ষম হলে তায়াম্মুম করবে। অপবিত্র ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর জিকির এবং কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যশীল বাক্যাবলীর মাধ্যমে দুআ করা জায়েজ। তবে ঐ বাক্যের মাধ্যমে তিলাওয়াত উদ্দেশ্য হওয়া যাবে না, উদ্দেশ্য হবে শুধু দুআ। যেমন- বলল: “লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায জোয়ালেমিন”। (৪) তিলাওয়াতের জন্য কোরআনের ভাব মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ স্থান নির্বাচন করা: সুতরাং অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে এবং কোরআন শোনার প্রতি অমনোযোগী সমাবেশে তিলাওয়াত করবে না। কারণ এতে কোরআনের অমর্যাদা হয়। অনুরূপভাবে শৌচাগারেও কোরআন পড়া জায়েজ নেই। তিলাওয়াতের জন্য সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ- এতে একই সাথে তিলাওয়াত এবং মসজিদ অবস্থান উভয় সওয়াব পাওয়া যাবে। সাথে সাথে ফেরেশতাদের ইস্তিগফারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে-যখন স্বলাতের অপেক্ষায় থাকবে অথবা স্বলাত আদায় করার পর বসবে। তিলাওয়াত ও জিকিরের উদ্দেশ্যে যারা মসজিদে বসে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ বলেন্ত আল্লাহ যে সব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করেছেন এবং সেগুলোতে তার নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং সেখানে সকাল সন্ধ্যায় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, স্বলাত কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সে দিনকে যে দিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। (তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে) যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রুজি দান করেন। (সূরা নূর, ৩৬-৩৮)। (৫) খুব আদবের সাথে বিনম্র ও শ্রদ্ধাবনত হয়ে বসা: শিক্ষক সামনে থাকলে যেভাবে বসত ঠিক সেভাবে বসা। তবে দাঁড়িয়ে শুয়ে এবং বিছানাতেও পড়া জায়েজ আছে। (৬) আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার্থে “আউযুবিল্লাহ” বলা: আল্লাহ তায়ালা বলেন: যখন তুমি কোরআন পড়ার ইচ্ছা করবে তখন বল- আঊযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতু আনের রাজিম, (সূরা নাহল, ৯৮)। (৭) সকল সূরার শুরুতে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” পড়া: যদি সূরার মাঝখান থেকে পড়া হয় তাহলে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” পড়ার প্রয়োজন নেই। (৮) উপস্থিত ও সচেতন মন দিয়ে তিলাওয়াত করা: চিন্তা করবে কি পড়ছে। অর্থ বুঝার চেষ্টা করবে। মন বিনম্র হবে এবং ধ্যান করবে যে মহান আল্লাহ তাকে সম্বোধন করছেন। কেননা, কোরআন আল্লাহরই কালাম। (৯) তিলাওয়াতের সময় কান্নাকাটি করা: এটি নেককার সালেহীনদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন- যারা এর পূর্ব থেকে ইলম প্রাপ্ত হয়েছে- যখন তাদের কাছে এর তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা নতমস্তক সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং বলে: আমাদের পালনকর্তা পবিত্র, মহান। নি:সন্দেহে আমাদের পালনকর্তার ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা ক্রন্দন করতে করতে নতমস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় ভাব আরো বৃদ্ধি পায়, (সূরা ইসরা, ১০৭-১০৯)। ইবনু মাসঊদ (রা.) যখন রাসূলকে (স.) কোরআন শোনাচ্ছিলেন এবং পড়তে পড়তে- তখন কি অবস্থা হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী রূপে উপস্থিত করব, (সূরা নিসা, ৪১)- আয়াত পর্যন্ত পৌঁছোলেন, রাসূল (স.) বললেন,  “হাসবুক” (ব্যাস, যথেষ্ট) আমি রাসুলের (স.) দিকে তাকিয়ে দেখি তার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত, (বুখারি, ৪৬৬২)। (১০). তারতীল তথা ধীরে-ধীরে স্পষ্ট পড়া: এভাবে পড়া মোস্তাহাব। কেননা আল্লাহ বলেন, কোরআন আবৃতি কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, (সূরা মুজাম্মিল, ৪)। এভাবে পড়লে বুঝতে ও চিন্তা করতে সহজ হয়। রাসূল (স.)ও এমনই পড়তেন, তিলাওয়াত করতেন। উম্মুল মোমিনীন সালমা (রা.) ও রাসূলের (স.) তিলাওয়াত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমনটিই বলেছেন যে প্রত্যেক শব্দ পৃথক পৃথক ও সুস্পষ্ট ছিল। আবু দাউদ-মুসনাদের রেওয়াতে এসেছে,  রাসূল (স.) প্রত্যেক আয়াতের শেষে থামতেন। সাহাবি ইবনু মাসঊদ (রা.) বলেন: তোমরা কোরআনকে গদ্য আবৃত্তির ন্যায় বিক্ষিপ্তাকারে আবার কবিতার ন্যায় মিলিয়ে মিলিয়ে তিলাওয়াত করবে না (বরং কোরআনের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে তিলাওয়াত করবে) বিস্ময়কর বর্ণনা আসলে থামবে এবং হূদয় নাড়া দেয়ার চেষ্টা করবে। সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের কারো সংকল্প না হয়। তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে স্পষ্টকরে পঠিত অল্প তিলাওয়াত অনেক উত্তম, দ্রুততার সাথে পঠিত বেশি তিলাওয়াত থেকে। কারণ তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য তো বুঝা ও চিন্তা করা এবং এটিই ঈমান বৃদ্ধি করে। তবে হ্যাঁ, দ্রুততার সাথে পড়তে গিয়ে যদি শব্দের উচ্চারণ ঠিক থাকে তাড়া হুড়ার কারণে কোন রূপ বিভ্রাট-বিভ্রান্তি ও অক্ষরবিয়োগ বা অতিরিক্ত কিছুর সংযোগ সমস্যা না হয় তাহলে অসুবিধা নেই। এরূপ কিছু সৃষ্টি হলে বা উচ্চারণ বিভ্রাট দেখা দিলে হারাম হবে। তারতীলের সাথে পড়ার পাশাপাশি, তিলাওয়াতে রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ প্রার্থনা করা, আজাবের আয়াত আসলে তার নিকট আজাব ও বিপদ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং এগুলো থেকে নিরাপদ থাকার দোয়া করা, তার পবিত্রতার বর্ণনা সম্পর্কিত আয়াত আসলে “সুবহানাহু ওয়া তায়ালা” বা “জাল্লাত ক্বুদরাতুহু” জাতীয় বাক্য বলে তার পবিত্রতার স্বীকৃতি দেয়া মোস্তাহাব। রাসূল (স.) রাতে স্বলাত আদায়কালে এমনটিই করতেন, (মুসলিম)। (১১) যথাসম্ভব উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা: এটি মোস্তাহাব ও বটে। রাসূল (স.) বলেন্ত আল্লাহ তায়ালা নবীজীর উচ্চকণ্ঠে সুরেলা আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াতকে যে রূপ গুরুত্ব সহকারে শ্রবণ করেন এরূপ গুরুত্ব দিয়ে অন্য কিছু শুনেন না, (বোখারি, ৬৭৮৯)। এর দ্বারা কবুল ও পছন্দ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নবীজীর সুরেলা ও উচ্চকণ্ঠের তিলাওয়াতকে অন্য সকল আমলের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন এবং কবুল করেন। কিন্তু তিলাওয়াতকারীর কাছাকাছি যদি কেউ থাকে এবং আওয়াজের কারণে তার কষ্ট-বিরক্তি বোধ করে-যেমন ঘুমন্ত ও স্বলাতরত ব্যক্তি- তাহলে আওয়াজ বড় করে তাদেরকে বিরক্ত করা যাবে না। একবার রাসূল (স.) লোকদের নিকট এসে দেখলেন তারা উচ্চ আওয়াজের কিরাতে স্বলাত আদায় করছে। তখন তিনি বললেন : তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় প্রতি পালকের সাথে একান্ত কথা বলছ। অতএব কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে একে অন্যের উপর আওয়াজ বড় কর না, (ইমাম মালেক রহ.)। (১২) সুন্দর আওয়াজ ও সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করা: রাসূল (স.) এরশাদ করেন:  তোমরা স্বীয় আওয়াজের মাধ্যমে কোরআনকে সুন্দর কর, (আবু দাউদ, ১২৫৬)।তিনি আরো বলেন: যে ব্যক্তি সুরেলা কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করে না (করাকে পছন্দ করে না) সে আমাদের দলভুক্ত নয়, (বোখারি, ৬৯৭৩)। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে বাড়াবাড়ি

পর্যায়ের টানাটানি ও স্বর দীর্ঘ করার চেষ্টা করবে না। (১৩) তিলাওয়াতকালে কোরআনের আদব ও ইহতেরামের প্রতি লক্ষ্য রাখা: শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অহেতুক কাজ থেকে এবং চোখ, কান, এদিক সেদিক তাকানো থেকে বিরত রাখতে হবে। (১৪) ধারাবাহিক ও বিরতিহীন তিলাওয়াত করা: প্রয়োজন ব্যতীত মাঝখানে বিরতি না দেয়া। তবে হ্যাঁ সালামের উত্তর, হাঁচির জবাব এবং এ জাতীয় প্রয়োজনে থামার অনুমতি আছে বরং এগুলো মোস্তাহাব, যাতে সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হয়। অত:পর “আউযু বিল্লাহ” পড়ে নতুন করে তিলাওয়াত শুরু করবে। (১৫) সেজদার আয়াত পড়লে সেজদা করা: সেজদা ওজু অবস্থায় করতে হবে। “আল্লাহ আকবার” বলে সেজদায় “সুবহানা রাব্বিআল আলা” এবং অন্যান্য দোয়াও পড়বে। সেজদার তিলাওয়াতে সালাম নেই। যদি স্বলাতরত অবস্থায় সেজদার আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তাহলে স্বলাতেই সেজদা দিতে হবে। আল্লাহু আকবার বলে সেজদায় যাবে এবং আল্লাহু আকবার বলে উঠবে। (১৬)  খতম করার পর দোয়া করা: যিনি কোরআন খতম করবেন তার পক্ষে দোয়া করা মোস্তাহাব। সাহাবি আনাস বিন মালেক (রা.) সম্পর্কে প্রমাণিত যে, তিনি কোরআন খতম করলে পরিবারস্থ সকলকে একত্রিত করে তাদের নিয়ে দোয়া করতেন, (দারেমী)।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই