Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

খেলার মাঠে মার্কেট কেন

ইমরান হুসাইন

জুন ২৬, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


খেলার মাঠে মার্কেট কেন
  • আগামী দিনের ভবিষ্যৎদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচাতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ বিকাশে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলার মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো দিক বিবেচনা ও জাতির কল্যাণে খেলার মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে এই সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি শিশুর বিকাশে রাজধানীতে খেলাধুলা করার জন্য খোলা মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু আগামী দিনের কাণ্ডারী। যে আজকে শিশু অবস্থায় আছে একদিন সেই ধরবে হাল। তার হাতেই থাকবে বিশ্ব নেতৃত্ব। পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে বেড়ে উঠবে সে হবে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে পড়াশোনার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য চাই পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলাধুলা। যা শিশুর বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে। এর জন্য চাই খেলার উন্মুক্ত মাঠ কিন্তু আমাদের যত সীমাবদ্ধতা সব এই খেলার মাঠকেই ঘিরে। সকলের নজর যেনো এই খেলার মাঠে। যে কারণে দিন দিন আরো বেশি সংকুচিত হচ্ছে আমাদের খেলার মাঠ। খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে শিশুরা হচ্ছে ঘরমুখী আর ঝুঁকে পড়ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা অনলাইন ভিডিও গেমে। যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার কারণ তো নয়ই বরং শিশুর বিকাশে বাধার কারণ। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ১৫ মাসের অধিক সময় ধরে চার দেয়ালে বন্দি হয়ে পড়েছে শিশুরা। অনলাইন ক্লাসের অজুহাতে ভিডিও গেমস, কার্টুনে সারাক্ষণ লিপ্ত থাকছে তারা। যদিও মানা করা হয় যে, এটা করোনা এটা ক্ষতিকর। কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থা কি আছে আমাদের? বিকল্প ব্যবস্থা হলো খেলার মাঠ। কিন্তু সেখানেই বা স্বস্থি কই? খেলার মাঠেও চলছে দখলদারিত্ব। খেলার মাঠ দখল করে তৈরি হচ্ছে হাট-বাজার, তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিক মার্কেট। ফলে শিশুরা হয়ে উঠছে ঘরকুনো।  আশ্রয় নিচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ও অনলাইন গেমসে।যেকারণে শিক্ষার একটা অংশ সব সময়ের জন্যই অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে তাদের। আর এমন ঘটনা ঘটছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকাতে।

প্লেটোর মতে, শৈশবকালীন খেলা হচ্ছে পরবর্তী জীবনের জ্ঞানের ভিত্তি। খেলার প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দ লাভ। কিন্তু শিশুর বিকাশের জন্য খেলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাটনি স্মিথ বলেছেন, অনুকরণ, অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গঠন এই চারটি মূল প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবী সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি, শিশুর খেলা সেই চারটি প্রক্রিয়া নিয়েই গঠিত। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মানসিক, সামাজিক, আবেগ বিকাশেও খেলাধুলার গুরুত্ব অনেক। খেলার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি, সামাজিক জ্ঞানবোধ, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরের আয়তনের কমপক্ষে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ খেলার মাঠ বা খোলা জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানীতে আমরা দেখছি তা আছে মাত্র ৪ শতাংশ। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ হারিয়ে যেতে বসেছে। খালি পড়ে থাকা জমি দখলের পরিক্রমায় রাজধানীতে এখন খেলার মাঠ খুঁজে পাওয়া ভার। রাজধানীতে যেসব খেলার মাঠ ছিলো, সেগুলোর অধিকাংশই বেদখল হয়ে গেছে। খেলার মাঠ দখল করে সেই জায়গায় ঘরবাড়ি ও বহুতল মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে হাতে গোনা যে কয়েকটি খেলার মাঠ রয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ফলে রাজধানীর অধিকাংশ শিশু-কিশোর খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সি প্রতিটি শিশুর জন্য দিনে অন্তত এক ঘণ্টা বাইরে খেলাধুলা করার পরামর্শ দিচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক সন্তান কি সেই সুযোগ পাচ্ছে? ঢাকা শহরের মাত্র ২ শতাংশ শিশু খেলার মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ পায়। ২০ শতাংশ কিশোর এবং ২৯ শতাংশ কিশোরীর মধ্যে হতাশার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। শিশুরা খেলার সুযোগ পাচ্ছে না, বিশেষ করে মেয়েশিশুরা আরও বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিলো ১৮ লাখ। তখন নগর কর্তৃপক্ষের হাতে অর্ধশতাধিক খেলার মাঠ ছিলো। প্রতিটি স্কুল ও মহল্লায় ছিলো মাঠ, খোলা জায়গা। কিন্তু এখন ঢাকার জনসংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মাঠ রয়েছে মাত্র ২৪টি। এখন খোলা জায়গা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ১৫টি খেলার মাঠ রয়েছে। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে খেলার মাঠ রয়েছে মাত্র ৯টি। একটা সিটির জন্য মাত্র ৯টি মাঠ! সহজেই আমাদের কাছে অনুমেয় যে, এখানে বসবাসকারী  শিশুদের অবস্থা কিরূপ! পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না পেয়ে মাঠবিমুখ হয়ে উঠেছে এবং দিন দিন আসক্তি হয়ে পড়ছে অনলাইন ভিডিও গেমসে। রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এত ঘনবসতি অঞ্চলগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকা অন্যতম। যেখানে মানুষের অবকাশ গ্রহণের জায়গার স্বল্পতা অনেক বেশি। এখানকার ঐতিহ্যবাহী একটি খেলার মাঠ ‘ধুপখোলা খেলার মাঠ’। মাঠের চারপাশ ঘিরে বাজার হওয়ায় এখানকার পরিবেশও স্বাস্থ্যকর নয়। তবুও স্থানীয়রা সকাল-বিকাল খেলাধুলা করে থাকে। সকালে হাঁটাহাঁটি-দৌড়াদৌড়ি আর বিকেলে খেলাধুলা চলে নিয়মিতই। যে মাঠের একটা অংশের ভাগিদার ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ কিন্তু এখানেও থাবা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এমনটাই দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গেন্ডারিয়া এলাকায় ধুপখোলায় তিনটি মাঠের মধ্যে একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জমিটি খেলার মাঠ হিসেবে দেন। এরপর থেকে এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ হিসবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহার করে থাকে।

এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট পরিচালনা ও শরীর চর্চা করে থাকে। তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের একমাত্র শরীরচর্চা ও খেলাধুলা করার জায়গা এই মাঠ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ধুপখোলায় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ দখল করে সেখানে মার্কেট ও পার্ক  নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। আগের পরিকল্পনা হিসেবে গত ১০ জুন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামসুজ্জোহা ও সিটি কর্পোরেশনর সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হরিদাস মল্লিক মাঠের ভেতর ম্যাপ অনুযায়ী মাঠের চার কর্নারে খুঁটি বসান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে না জানিয়ে মাঠের মধ্যে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনায় বিষয়টি চোখের নজরে আসার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাস ও শিক্ষার্থীরা। এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মাঠ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছে গত ২০ জুন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাধুলার মাঠ দখল করে কেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা মার্কেট বানাতে হবে? মানবজীবনে কি খেলাধুলা বা খেলার মাঠের কোনো গুরুত্ব নেই?

জীবন-জীবিকা চালাতে অবশ্যই টাকা পয়সার গুরুত্ব আছে। কিন্তু জীবনের একটা অংশকে বাদ দিয়ে নয়। বাণিজ্যিক মার্কেটের অবশ্যই গুরুত্ব আছে জনগণের পর্যাপ্ত চাহিদা মেটানোর জন্য এর এটার অবশ্যই দরকার। তাই বলে খেলার মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করার পরিকল্পনা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। গ্রামের একটা খেলার মাঠে অনেক জায়গা থাকে। খেলার মাঠ ছাড়াও অনেক বিস্তীর্ণ জায়গা পড়ে থাকে। সেখানে বিভিন্ন বয়সিরা মানুষরা খেলাধুলা করে থাকে। মাঠের আশেপাশে দোকান থাকলেও সমস্যা হয় না  কিন্তু শহরে তার বিপরীত। বিশেষ করে ঢাকা শহরে তাও আবার পুরান ঢাকাতে। ঘনবসতিপূর্ণ এই জায়গাতে মানুষের তুলনায় খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। যাই আছে সেখানে খেলা করার সুস্থ পরিবেশ অনুপস্থিত। যেসব ছেলেমেয়েরা একান্তই খেলা পছন্দ করে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলার জায়গা পায় না তাদের একটা অংশ ছোট ছোট  গলির ভেতরেই খেলা শুরু করে দেয় আর আরেকটি অংশ ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অনলাইন গেমসে যুক্ত হয়। যা বর্তমান সময়ের জন্য একটা মারাত্মক ব্যধি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।  খেলার মাঠের সুস্থ পরিবেশের অভাবে একটা প্রজন্ম মাঠ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। ফলে এসব শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচাতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ বিকাশে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলার মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো দিক বিবেচনা ও জাতির কল্যাণে খেলার মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে এই সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি শিশুর বিকাশে রাজধানীতে খেলাধুলা করার জন্য খোলা মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই