Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

এবারের লকডাউন বেশি জরুরি

শেখ আনোয়ার

জুন ২৯, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


এবারের লকডাউন বেশি জরুরি
  • আগের লকডাউন মানার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দ্বিধা ছিলো। জীবিকার কথা চিন্তা করে করোনাকে অগ্রাহ্য করে কাজে বেরিয়েছি আমরা। এবার আর রক্ষা নেই। প্রাণঘাতী ডেল্টা করোনার ছোবল থেকে প্রাণ বাঁচানোটাই মুখ্য। তাই আসুন, এবার সবাই মিলে লকডাউনের সরকারি নির্দেশাবলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। করোনা থেকে নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করি

করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ১ জুলাই থেকে সারা দেশে কঠোর লকডাউন দিয়েছে সরকার। লকডাউনের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। তবে এর আগের লকডাউনে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। সব ধরনের যানবাহনের ওপর ছিলো নিষেধাজ্ঞা। লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোরভাবে মাঠে থাকার কথা ছিলো সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির। কিন্তু বাস্তবতা হলো লকডাউন শতভাগ কার্যকর হয়নি। এমনকি মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে।

এদিকে দেশে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা যখন প্রকাশ পাচ্ছে তারপরও ঢাকার রাস্তায় বের হলে মনে হয় ভাইরাসের কোনো অস্তিত্ব নেই। বাজারের ভিড় কিংবা যানজটে আটকে থাকা অবস্থাতেও অনেকে মাস্ক পরার বিষয়টি গ্রাহ্য করেন না। যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কিংবা নেপালের মতো একই ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে না তো বাংলাদেশ? সঙ্গত কারণেই এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এবার বুঝি করোনা ভাইরাসের শক্তি কমবে। কারণ করোনার ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই দ্বিতীয় ঢেউ আস্তে আস্তে বিদায় নেয়ারই কথা। সবাই জানেন, ভাইরাস সাইক্লোনের মতো এসে ধীরে ধীরে কমে যায়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেটি ঘটছে না। সংক্রমণ বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। বাংলাদেশে রোগসংক্রমণ শনাক্ত হওয়া এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ার তথ্যই বলছে, করোনাগ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। তার মানে, ভাইরাস ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ওষুধ প্রতিরোধকারী ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান আমরা হরহামেশাই পাই। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমণের শিকার হলে অনেকেরই প্রাণ যায়। করোনা হলো অতি সংক্রমণকারী ভাইরাস। এই ভাইরাস যদি সমস্ত রকম ওষুধ এবং প্রতিষেধক প্রতিরোধকারী হয়, তাহলে তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেটি কল্পনাতেই আনা যায় না।’ এবার হয়তো তাই ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘রূপ বদল করে করোনা হয়েছে বি.১.৬১৭.২ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। করোনার আগের স্ট্রেইনগুলোর চেয়ে ডেল্টা প্রজাতি আরও বেশি সংক্রামক। অতি সংক্রামক হওয়ায় একে ‘বিশ্বের জন্য উদ্বেগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

করোনা ভাইরাসের এই ধরন ভারতের পর নেপালে কী পরিমাণ সর্বনাশের কারণ হয়েছিল তা কারো অজানা নয়। হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায় প্রতিদিন। এবার বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক খবর হলো, সমপ্রতি আইসিডিডিআরবির গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ রোগীর শরীরে এই অতিসংক্রামক ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে করোনা সংক্রমণের ৯০ শতাংশেরও বেশি হলো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। যুক্তরাজ্যের ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, ‘চিকিৎসকরা সমপ্রতি ডেল্টা করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে নানারকম উপসর্গ দেখতে পেয়েছেন। যার অর্থ করোনায় সংক্রমিত হওয়ার শুরুতে, আগে যেমন কাশি ছিলো পরিচিত উপসর্গ। সেটি আর থাকছে না। করোনার ডেল্টা সংস্করণ ভাইরাসটি প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার মতো শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে। এই শক্তি সঞ্চয় করায় তার গতিপথ আর সরল নেই। বাঁকা হয়ে গেছে। এই ডেল্টা ধরনেরই সামান্য বদলে যাওয়া নতুন রূপ ডেল্টা প্লাস এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতসহ নানান দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ডেল্টা প্লাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০০ বলে জানানো হয়েছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে। এভাবেই করোনা পদে পদে বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হওয়ায় সঙ্গত কারণেই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলা খুব দুষ্কর।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ভারতীয় অতিসংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে শনাক্ত হয়। পরে সীমান্তের জেলাগুলো ছাড়াও অন্য জেলায় রকেটগতিতে ছড়ায় অদৃশ্য এই শত্রু। শুধু জেলা শহর নয়, এবার গ্রামেও যেভাবে করোনার থাবা বিস্তৃত হয়েছে, তা অকল্পনীয়। গ্রামে ঘরে-ঘরে করোনার উপসর্গ, জ্বর-সর্দি-কাশির খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেশির ভাগই প্রকাশ পাচ্ছে না। নানা অজুহাতে পরীক্ষায় অনীহা। করোনার উপসর্গে আক্রান্তদের অনেকে এড়িয়ে যাচ্ছেন মৌসুমি জ্বর বলে। জ্বর, সর্দি-কাশি, গা ব্যথা ও ডায়রিয়া দেখা দিলেও বেশির ভাগ লোক ডাক্তার দেখাতে অনীহা  প্রকাশ করছে। সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ মানুষ টেস্ট করাচ্ছে না। তাদের বারবার বলেও কাজ হচ্ছে না। অনেকে সামাজিক বয়কটের শিকার হওয়ার শঙ্কায় বিষয়টি চেপে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘কেউ যদি মনে করে যে তার কেবল ঠাণ্ডা লেগেছে তবে সে করোনার পরীক্ষা করার কথা চিন্তাই করতে পারে না। এর ফলে অধিক সংখ্যক সংক্রমিত ব্যক্তি নিত্যদিনের মতো জীবনযাপন করে। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।’

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ‘এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভাইরাস আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। নিয়ন্ত্রণহীন চলাচলে বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে ইমিউনিটির কারণে যদি ভাইরাসটি টিকে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ! সেটিই এখন বড় চিন্তার বিষয়।’ আমরা কি বর্তমানে সেরকম ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে যাচ্ছি? এবার কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কিছু থাকবে না?

সরকারকে অবশ্যই ভাইরাস এবং অ্যান্টিজেন টেস্ট দুটোই বাড়াতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগকে এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা আরও কঠোরভাবে বাড়াতে হবে। যাতে করে তাদের কারণে অন্যের সংক্রমণ না বাড়ে। এছাড়াও করোনার ওষুধ ও অক্সিজেনের মজুত বাড়াতে হবে। আইসিইউ ব্যবস্থাসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সুযোগ আরও অনেক বাড়াতে হবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করার জন্য মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে জনাকীর্ণ এলাকাগুলোর জনসমাগম অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে বন্ধ করতে হবে। লকডাউনে বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষের যেনো খাদ্যাভাব না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে নগদ অর্থ কিংবা খাদ্যসামগ্রীর। আবারো প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যে কোনো শিক্ষা নিইনি, তা কিন্তু নয়। সেই শিক্ষা এবারে ডেল্টা তরঙ্গ মোকাবিলার কাজ অনেক সহজ করবে। গতবার সাধারণ মানুষ করোনা মোকাবিলায় মানবিক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে পুলিশ-প্রশাসন ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় যায়। সংক্রমিতদের পাশে দাঁড়ায়। সংক্রমিত হওয়ার ভয় উপেক্ষা করে পরস্পরের হাত ধরে মানবিক স্পর্শ নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যাওয়ার কারণে সে যাত্রা করোনাকে অনেক সহজে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।

গত দেড় বছরে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যে উন্নত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। আজ জেলায় জেলায় বহু গ্রামীণ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর দেখা যাচ্ছে— যা কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় ছিলো। বাস্তব সত্যি কথাটা মাথায় রেখে বলতে হয়, বিশ্বজুড়েই এখন ভ্যাকসিনের সংকটকাল। মনে রাখতে হবে, অনেক দেশ যেখানে এখনো ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করতেই পারেনি। তার মধ্যেও শেখ হাসিনা সরকার পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশে গণটিকাদান শুরু করে। এখনো ভ্যাকসিন আসছে। ভ্যাকসিন সংকটের কারণে কিছুদিন টিকাদান ব্যাহত হলেও করোনা পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ যেনো ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরি করতে পারে, সেই নিরন্তর প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জরুরি প্রেক্ষাপটে এবার প্রয়োজন আমাদের আত্মশাসন। যার যার ব্যক্তিগত সুরক্ষা, তার নিজ হাতে রাখার চেষ্টা করা। যাতে তিনি আক্রান্ত না হন। তিনি এবং তার পরিবার আক্রান্ত হলে ক্ষতি তারই হবে। প্রয়োজন অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব ভুলে সবাই মিলে আগের মতো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচল করা। আবার কিছুদিন জীবন-জীবিকা, ব্যবসা শাটডাউন রাখা।

আগের লকডাউন মানার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দ্বিধা ছিলো। জীবিকার কথা চিন্তা করে করোনাকে অগ্রাহ্য করে কাজে বেরিয়েছি আমরা। এবার আর রক্ষা নেই। প্রাণঘাতী ডেল্টা করোনার ছোবল থেকে প্রাণ বাঁচানোটাই মুখ্য। তাই আসুন, এবার সবাই মিলে লকডাউনের সরকারি নির্দেশাবলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। করোনা থেকে নিজে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করি।

লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই