Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

নদী দখল-দূষণমুক্ত ও সংরক্ষণে তৎপর এনআরসিসিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুন ৩০, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


নদী দখল-দূষণমুক্ত ও সংরক্ষণে তৎপর এনআরসিসিবি

নদী দখল-দূষণমুক্ত ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন (এনআরসিসিবি)। বিশেষ করে ঢাকা শহরের চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু এবং তুরাগ নদীর তীরভূমি থেকে ২০ হাজার ১৫৯টি  অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ৭২৬ একর ভূমি উদ্ধারে সুপারিশ ও কার্যকরে ভূমিকা রেখেছে কমিশন। কমিশনের সুপারিশের আলোকে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের কার্যক্রম, নদীতীর দখলমুক্ত করা এবং নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে নৌ-মন্ত্রণালয়।

উচ্ছেদের পর পুনর্দখল রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নদীর উভয় তীরে ওয়াকওয়ে, পাকা সিঁড়ি, বসার বেঞ্চ, ইকোপার্ক নির্মাণ, নদীর পাড় বাঁধাই, গাইড ওয়াল নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে গড়ে উঠা ছোট-বড় লঞ্চ-স্টিমার তৈরি ও মেরামতের জন্য অননুমোদিত ডকইয়ার্ডের কারণে নদীদূষণ, পাড় সংরক্ষণসহ নৌপথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বুড়িগঙ্গাকে আপন রূপে ফিরিয়ে দিতে ডকইয়ার্ডগুলোকে সরানোর সুপারিশ করেছে কমিশন।

সূত্র মতে, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। কালের বির্বতনে সারা দেশে নদীগুলো দখলদারদের দখলে। দূষণের কারণে জনজীবনের জন্য অস্বস্তি হয়েছে অধিকাংশ নদ-নদী।  দেশের নদ-নদী রক্ষায় ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। কিন্তু সুপারিশ ছাড়া আর কিছুই করার এখতিয়ার ছিলো না কমিশনের। ফলে সুপারিশ, পরিদর্শন, সভা, সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো কমিশনের কাজ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনআরসিসিবির সুপারিশগুলো ফাইলবন্দি থেকেছে। ২০১৯ সালে ২ ফেব্রুয়ারি দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। পরবর্তীতে নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইন-২০২০’ এর প্রণয়ণ করা হয়।  ২০১৩ সালের নদীরক্ষা কমিশন আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য কোনো শাস্তি নির্ধারিত ছিলো না।

এনআরসিসিবি সূত্র জানায়, ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’ দেশব্যাপী নদী রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সারা দেশে নদীর বর্তমান অবস্থা যাচাই, পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কৌশল এবং দূষণমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে ‘নদীদূষণ, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং অন্যান্য দূষণ থেকে ৪৮টি নদীরক্ষা এবং নদীর তথ্যভাণ্ডার তৈরি ও গবেষণা প্রকল্প (প্রথম পর্ব)’ ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’ কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর সারা দেশে প্রায় ৫৮ হাজার নদী দখলদার ও দূষণকারীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ হাজারের মতো দখলদার উচ্ছেদ হয়েছে। নতুন আইনে নির্বাহী ক্ষমতায় পাওয়ায় কমিশনের কাজে গতি ফিরেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর (বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন) সমন্বয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে খাল, বিল, জলাশয় ও সমুদ্র উপকূল রক্ষা ও দূষণমুক্ত রাখাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহারে মাধ্যমে নদ-নদী পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে বেশ সাফল্য এসেছে।

বর্তমান আইনে বাংলাদেশের সকল প্রকার নদ-নদী, জলাধার, পানির উৎস রক্ষা করা, অবৈধ দখল মুক্তকরণ, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদী খননের বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করবে কমিশন। অন্য আইনে যা কিছুই বলা হোক না কেন, নদী দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, মৎস্যচাষ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সরকারি কোনো কর্মকর্তাও যদি নদ-নদীর জায়গা, তীরভূমি ইত্যাদি অবৈধভাবে কারো নামে বরাদ্দ দেন, তারাও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে দোষী হবেন বলে আইনে বলা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগে ‘নদী রক্ষা কোর্ট’ নামে এক বা একাধিক কোর্ট স্থাপিত থাকবে। নদী ও জলাধার সংক্রান্ত সকল বিষয় নিয়ে এই আদালত বিচার করবেন। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। নদী দখল, দূষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দিতে পারবে মোবাইল কোর্ট। কমিশন ছাড়াও নদী রক্ষার্থে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা নাগরিক কোর্টে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারবেন। একমাস বা ততোধিক শাস্তিযোগ্য কোনো নদী সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, এমন সন্দেহে কমিশনের কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি বা নৌপুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এছাড়া ফৌজদারি বিভিন্ন আইনের ধারা অনুযায়ীও শাস্তির বিধান রয়েছে এই আইনে। নদীর জমির অবৈধ দখল সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি হবে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। নদীর প্লাবনভূমি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে লিজ বা সাব-লিজ দেয়া হলে, নদ-নদীর জরিপ, পর্চা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া হলে, ডুবোচরকে চরে রূপান্তরের চেষ্টা, পানিপ্রবাহে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতিসাধন ইত্যাদি করার চেষ্টা করা হলে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। নদ-নদীর জমিতে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বা অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে দখল বা নদীর ক্ষতি করে ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করা হলেও একই শাস্তি হবে। অন্য আইনে যা কিছুই বলা হোক না কেন, নদ-নদীর অবৈধ দখল-দূষণ, নাব্যতা হ্রাস, পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য বিঘ্নিত বা সংকটাপন্ন বলে মনে করে ওই এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করতে পারবে কমিশন। অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং পুনর্দখল রোধে এবং উচ্ছেদ ও উদ্ধারে জেলা প্রশাসক ও কালেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, পরামর্শ বা সুপারিশ দেবে। যা তাদের আবশ্যই পালন করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্ছেদ ও নদ-নদীর ভূমি উদ্ধারে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবে কমিশন।

আইন প্রয়োগের ক্ষমতা বা নির্দেশনার ক্ষমতায় পাওয়ার পর সারা দেশে নদী রক্ষায় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এস এম আলী কবীর। তিন বছরের জন্য সচিব পদমর্যাদা ও সুবিধা দিয়ে সরকার তাকে এ পদে নিয়োগ দিয়েছে। তিনি যোগদান করার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কাজে নতুন গতি পেয়েছে। মাঠ প্রশাসনের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কমিশনের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন তিনি। নানা উদ্যোগ এবং কঠোর নির্দেশনায় করোনার চলমান সংকটেও ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

আমারসংবাদ/জেআই