ঢাকা
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,
আব্দুর রহমান
জুলাই ১৫, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম
ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ২০০৭ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ সভাপতি, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সেদিন মূলত বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিকেই অবরুদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাসভবন সুধাসদন ঘেরাও করে। এমন অবস্থায় তিনি নিজ বাসায় অবস্থান করছিলেন এবং ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে সুধাসদন থেকে নিয়ে যায় এবং ‘বন্দি’ অবস্থায় তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে। সে সময় বেশ কয়েকটি হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ১০ মাস ২৫ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তখন তিনি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার না করে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করছিল— সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে নরকে পরিণত করেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে। গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকেই সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার ৫৯ দিন পর। এখানেই জেনারেল নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক ইচ্ছেটা স্পষ্ট। এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। এদের জন্যই স্বাধীনতা যুদ্ধ এত রক্তক্ষয়ী হয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এরাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত তথা খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে জটিলতা সৃষ্টি করলে সে সময়ে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জেনারেল মইন তার স্মৃতিচারণ গ্রন্থ ‘শান্তির স্বপ্নে’ গ্রন্থে লিখেছেন, তারা আড়াইটার সময় বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। ভেতরে গিয়ে শোনেন, প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজ করছেন। তাদের একটি কামরায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করার পর প্রেসিডেন্টের দেখা মেলে। প্রেসিডেন্টকে তারা ‘মহা-সংকটময় পরিস্থিতি’ থেকে দেশকে উদ্ধার করার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখার সময় নেন। দীর্ঘ নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে মত দেন। সেই সাথে তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেবেন বলে জানান। বইতে ৬টার সময় বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা লিখেছেন মইনুদ্দীন, অর্থাৎ দুই ঘণ্টার মতো তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন। এই দুই ঘণ্টায় তারা কীভাবে কি বুঝিয়েছিলেন প্রেসিডেন্টকে, কোন প্রেক্ষাপটে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে রাজি হলেন— তার কোনো স্পষ্ট ধারণা এ লেখায় পাওয়া যায়নি। বঙ্গভবনেই প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন দুটি নাম প্রস্তাব করেছিলেন, একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস, অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ। প্রফেসর ইউনুসকে প্রথম ফোনটি করেন জেনারেল মইন। প্রফেসর ইউনুস অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে তিনি যেমন দেখতে চান, সেরকম বাংলাদেশ গড়তে খণ্ডকালীন সময় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আরো দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিতে আগ্রহী তিনি। সে মুহূর্তে ড. ইউনুসের কথার মর্মার্থ বুঝিনি। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, তিনি একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও পরিস্থিতির কারণে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল।
ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগানো হয় গভীর রাতে। প্রধান উপদেষ্টা হবার আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চান তিনি। আধ ঘণ্টা পর ফিরতি ফোনে সম্মতি জানান তিনি। ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নেন প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের ধারণা, এখন প্রায় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে এই বলে যে, ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এত বছর পর এসে এ কথা হলফ করে বলা যায়, বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে শুধু জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মাইনাস করাই ছিলো এই ফর্মুলার মূলে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে পরিচালিত সরকারের চরিত্র যেমনটা হয় আর কি! কারণ, তারা যুগে যুগে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চেয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূকে দেখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই তিনি জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর তার দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য চলে নানামুখী চক্রান্ত। কিন্তু ব্যর্থ হয় সব ষড়যন্ত্র। সব বাধা অতিক্রম করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ব্রতী হয়ে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা।
[media type="image" fid="133039" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]
যৌথবাহিনী গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলায় ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করে। গণমানুষের নেত্রী যখন কারাগারে, তখন এ দেশের আপামর জনগণ তার অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তার সাব-জেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা যান চারজন। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় ঢাকা শহরের ২৫ লাখ মানুষ জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর দিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছিল। আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে সত্য কথা উচ্চারণে সব সময়ের মতোই বড় বেশি সপ্রতিভ ছিলেন তিনি। অবশেষে আইনি মোকাবিলার মাধ্যমে ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনা কারাগার থেকে মুক্তি পান।
বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হাজারো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে দেশ এবং দেশের জনগণ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে। পরবর্তীতে তিনি তার সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা, পরিশ্রম ও দেশপ্রেমের কারণে ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের মানুষ আর জোট সরকারের দুঃশাসনে ফিরে যেতে চায় না, শেখ হাসিনার মাঝে পুরো বাঙালি জাতি খুঁজে পায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ছিলো, সেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব, সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে আজ শুধু উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার মাইলফলকই স্পর্শ করেনি; বরং শেখ হাসিনার মানবিক নেতৃত্ব আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের কাছে উন্নয়ন আর মানবিকতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। শত সংকট আর সম্ভাবনায় শেখ হাসিনাই বাংলার মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের শেষ ঠিকানা। যখনই এ দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে, তখনই গণতন্ত্র রক্ষায় ঢাল হিসেবে সামনে দাঁড়িয়েছেন শেখ হাসিনা। এ দেশের মুক্তিকামী, আপামর জনতা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে— মানুষের মৌলিক অধিকার, সংবিধানের চার মূল নীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমুক্ত এবং অসাম্প্রদায়িক সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিকল্প শুধুই তিনি। আর কেউ নন।
লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
আমারসংবাদ/জেআই
