আহমেদ ইউসুফ
জুলাই ১৬, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম
দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক ধাপে সেটি ওঠানামা করেছে। ২০২০ সালের মার্চে প্রথম শনাক্ত এবং এপ্রিলে প্রথম মৃত্যুর পর পুরো দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ নাগরিকদের মাঝে সমূহ ভীতি তখন ফুটে উঠেছিল। তারপরই সরকার ঘোষিত লকডাউনে সর্বাত্মক সাড়া পড়ে। সেই পরিক্রমায় একই বছরের মার্চের ১৬ তারিখে সরকার ঘোষণা দেয়, ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। পরে প্রধানমন্ত্রীর আরেক ঘোষণায় পরিস্থিতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলার ঘোষণা আসে। সে থেকে শুরু হয়ে পুরো ২০২০ সাল এবং ২১-এর শেষলগ্নে আমরা উপস্থিত হতে চলেছি। দিনক্ষণ হিসাব ছাড়াও কার্যত প্রায় দুবছর হতে চলল দেশের শিক্ষাকার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।
তবে এক বাক্যে সর্বস্তরের শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে বললে কিছুটা ব্যত্যয় হবে। সব শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকলেও দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম দিক থেকে তাদের একাডেমিক সব কার্যক্রম অনলাইন মাধ্যমে চালিয়ে নিচ্ছে। যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামমাত্র অনলাইন ক্লাসের বাইরে কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না থাকায় কর্তৃপক্ষরা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা যায়।
তবে গেল ৬ মে কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সভায় অনলাইন পরীক্ষার বিষয়ে অনুমোদন পাওয়া যায়। তাই পেছনের কথা ছেড়ে বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনা এবং ডিজাস্টার মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেটি যথোপযুক্ত কিনা- এটি এখন বিবেচ্য বিষয়। ৬ মে’র সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইন পরীক্ষার অনুমোদন মিললেও দেখা যায় শিক্ষার্থীরা অনলাইন পরীক্ষার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান প্রকাশ করেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেওয়া এবং স্বশরীরে পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ৩১ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ?বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এক ভার্চুয়াল বৈঠকে অনলাইন কিংবা স্বশরীরে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে কিংবা স্বশরীরে পরীক্ষা শুরুর ঘোষণা আসতে থাকে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বশরীরে পরীক্ষা শুরুও হয়। তবে জুনের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পুনরায় স্বশরীরে হওয়া সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
তারপরই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে অনলাইন কিংবা অফলাইন যে কোনো পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে মতপ্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে এর মধ্যেও অনেক শিক্ষার্থীর অনলাইন পরীক্ষায় অনাগ্রহের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষকদের মতামত কতটুকু ইতিবাচক হবে- এটি আরেক বিষয়।
এক্ষেত্রে দেখার বিষয় যে, অধিকাংশের বেশি শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষায় আগ্রহ প্রকাশ করলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষায় অনাগ্রহী। যদিও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম সেশনজট ছাড়াই অনলাইন পরীক্ষার সুবাদে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পেরেছেন। সেক্ষেত্রে এই অনাগ্রহের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পেছনে পড়ে আছেন। অবশ্য প্রথম দিকে অনলাইন পরীক্ষার বিরোধিতা করার পেছনে যৌক্তিকতাও ছিল। কারণ, বাংলাদেশে সরকারি সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সজাগ দৃষ্টি অর্জনে দীর্ঘ সময় ব্যাহত হওয়ার প্রবণতা প্রকট।
তবে ৬ মে অনলাইন পরীক্ষার অনুমোদন পাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে নিজেদের সক্ষমতা কতটুকু বৃদ্ধি করেছে কিংবা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় যখন পরীক্ষা স্থগিত হলো, তখনও শিক্ষার্থীরা অনলাইন পরীক্ষায় অনাগ্রহী কেন- এ প্রশ্নগুলো বরাবরই উত্থাপিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়া এক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৬৬ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষায় আগ্রহী। অপরদিকে অনলাইনের বিপক্ষে ১৭ শতাংশ। ঈদের পর স্বশরীরে পরীক্ষা দিতে চান ১৫ শতাংশ, এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন চান এক শতাংশ; বাকিরা অটো পাস এবং শুধু ইনকোর্স অনলাইনে পরীক্ষা দিতে চান।
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় : যেখানে শিক্ষার্থীরা অনলাইন জরিপে অংশ নেন এবং পরীক্ষার বিষয়ে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই অনলাইন পদ্ধতিকে উপেক্ষা করেন। এর পেছনে মূল কারণ কি হতে পারে? এখানে অসামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচিত হবে, নাকি শুধু ভার্চুয়াল মাধ্যমকেই উপেক্ষা?
প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের মনোভাব ছিল ডিভাইস নেই, সামর্থ্য নেই। তবে পরবর্তীতে ইউজিসির ঋণ নিয়ে অনেকেই ডিভাইস-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করেছে। তবুও কেন শিক্ষার্থীদের অনীহা। এমনকি যাদের একটি নয় বরং তিনটি ডিভাইস রয়েছে, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ যখন অনলাইন পরীক্ষার বিরোধিতা করেন, তখন অনাগ্রহীতার প্রশ্নটি ক্ষীণ হয়ে আসে। সর্বতোভাবেই এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনলাইন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং সমূহ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তর ধারণা প্রদান করা আবশ্যক।
পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে যেসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পরীক্ষা চালু করেছে, তাদের বাকিদের অনুসরণ ও সহযোগিতা আদান-প্রদান হওয়া জরুরি। তাছাড়া বৈশ্বিক কাঠামোর কথা বিবেচনা করলে নিকট-ভবিষ্যতে কাজের ধরন পাল্টে গিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যম ধাবিত হওয়ার যে রূঢ় বাস্তবতা অপেক্ষমাণ, সেটি শিক্ষার্থীদের বুঝে নেওয়া উচিত। কারণ, সেই কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারি হওয়ার পালা তাদের। স্বাভাবিকভাবে যে কোনো মহামারি কিংবা অতিমহামারি থেকে মানব সভ্যতা এক বছর কিংবা হাতেগোনা কদিনে নিস্তার পাওয়ার নজির খুব একটা নেই। বরং বছরের পর বছর, এমনকি দশক পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মহামারি প্লেগের বিস্তার এবং স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়, ‘ব্ল্যাক ডেথ’ বা কালো মৃত্যু নামে পরিচিত ওই মহামারি ১৩৪৬ সাল থেকে ১৩৫৩ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। আবার স্প্যানিশ ফ্লু ১৯১৮ সালে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে পরিচিতি পায়। যেটি ছিল একটি অস্বাভাবিক মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা-ঘটিত বৈশ্বিক মহামারি। ১৯১৮-এর জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি ৫০ কোটি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছিল, যা সে সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা আনুমানিক ১.৭ থেকে পাঁচ কোটি বা কোনো কোনো হিসাবে ১০ কোটির মতো মানুষ মারা গিয়েছিল। তার মানে করোনা মহামারি ঠিক কবে নাগাদ বিশ্ববাসীকে মুক্তি দেবে, তার কোনো সঠিক ধারণা এখন পর্যন্ত কোনো সংস্থা বা দেশের কাছে পরিষ্কার নয়।
ইতোমধ্যে ১২ জুলাই ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল এক বিবৃতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে এবং লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা এখনও ব্যাহত হচ্ছে। ১৯ দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, যা ১৫ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
যদিও এর আগে ২০২০ সালের শেষ দিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দীর্ঘদিন পর তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়কে কার্যত এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এমনকি কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে সঠিক কোনো নির্দেশনা গণমাধ্যমে আসেনি। বরং তারিখ পরিবর্তন করে প্রায় দুবছর হতে চলল সব শিক্ষাকার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে আছে।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক ভয়াবহ শিক্ষাজটের কবলে পড়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অটো পাস এবং আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও স্নাতক পর্যায়ে এ পদ্ধতি অমূলক বলেই বিবেচিত। বরং এক্ষেত্রে ইউজিসি ও উপাচার্যদের সম্মতিতে প্রণয়নকৃত অনলাইন পরীক্ষা এবং ডিজাস্টার রিকভারি প্ল্যানগুলো কালক্ষেপণ না করে বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি। আরেকটি বিষয় হলো, যেসব শিক্ষার্থী এতদিন স্বশরীর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তারা কার্যত অনলাইন পরীক্ষার বিরোধিতা করেছেন- বিষয়টি এমন নয়। বরং দ্রুততর সময়ে পরীক্ষা দিতে স্বশরীরে পরীক্ষা দেওয়াকে সঠিক বলে মনে করেছিলেন। এ বিষয়ে আন্দোলনকারী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের কাজী আরেফিন শুভ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা মূলত পরীক্ষা দিতে চাই। সেটা যে কোনো মাধ্যমেই হোক। যদি আমাদের আজ বলা হয় অনলাইনে পরীক্ষা, আমরা রাজি আছি। কারণ, আমরা সেশনজট থেকে মুক্তি চাই। আমাদের চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে।’ কার্যত এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী এখনও অনলাইন পরীক্ষা বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে আসছিলেন, তাদেরও উচিত অনলাইন পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে উদ্যোগী হওয়া। কারণ, এসব শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর এমন একটি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, যেখানে দক্ষতার মূল্যায়নের সঙ্গে তাদের রুটিরুজির সম্পর্ক থাকবে। অর্থাৎ, এমন হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক হবে যে, চাকরির ক্ষেত্র ভার্চুয়াল এবং ফিজিক্যাল দুই ধারণার সমন্বয়। অপরদিকে যেখানে সরকারের স্পষ্ট বিবৃতি- ভ্যাকসিন প্রদান ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। বিশেষত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের শতভাগ টিকা দিয়ে খোলার কথা। যদিও কবে নাগাদ সেটি সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে উল্লেখ নেই। কাজেই এখনই প্রস্তুতি নেওয়াসাপেক্ষে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা শুরু করাটা অধিক যুক্তযুক্ত হবে। এর পাশাপাশি ভ্যাকসিন কার্যক্রম সম্পন্ন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে তাগিদ বাড়ানো দরকার। এটিই সঠিক পথ বলে বিবেচিত হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
আমারসংবাদ/জেআই