Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫,

বিকাশমান ড্রেজিং শিল্প : নদী অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

মো. কামরুল আহসান তালুকদার পিএএ

জুলাই ১৭, ২০২১, ০৫:৫০ পিএম


বিকাশমান ড্রেজিং শিল্প : নদী অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

এক সময় হোয়াং হো নদীকে চীনের দুঃখ বলা হতো। প্রতিবছর প্রলয়ংকরী বন্যায় প্লাবিত হতো মাঠ-ঘাট, ঘরবাড়ি আর ফসলের ক্ষেত। হাজার বছর আগে চীনের সম্রাট দেশের নামকরা ২০ জ্ঞানী-গুণী আর বিশেষজ্ঞকে তলব করে হোয়াং হোর হাত থেকে চীনকে বাঁচানোর জন্য উপায় খুঁজে বের করতে বললেন। অবশেষে রিপোর্টে উল্লেখ করা হলো, হোয়াং হোর চলার পথ মসৃণ করতে হবে। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পানির প্রবাহ যেন কোথাও বাধাগ্রস্ত না হয়, তাহলেই এ সমস্যার সমাধান হবে। কিছুক্ষণ ভেবে সম্রাট বললেন, তবে তা-ই হোক। হোয়াং হোর গতিপথ হয়ে গেল মসৃণ। প্রবাহ হয়ে গেল নিরবচ্ছিন্ন। অবসান হলো চীনের দুঃখ নামে অভিহিত হোয়াং হোর অপবাদ। এতে দুর্ভিক্ষ আর অকাল বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেল চীন। সেই থেকে আজও হোয়াং হো অবিরত প্রবাহিত হচ্ছে। চীনা ভাষায় হো মানে নদী। হোয়াং হোকে তারা মাদার রিভার বলে মানে। যারা ৬ থেকে ৯ হাজার মাইল দীর্ঘ গ্রেটওয়াল বানিয়েছে নিখুঁত পাথর ব্যবহার করে, তারা নদীর বালি ও পলি অপসারণ করতে পারবে না- এটা হতে পারে না। এটা চীন করে দেখিয়েছে।

নদীর সংস্কার ও পরিচর্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০২০ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় বছরব্যাপী নদী খননের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক সভাপতি শেখ হাসিনা। নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা এবং ভাঙন প্রতিরোধে বড় নদীতে পুরো বছরের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা থাকতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। নদীপ্রবাহ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নদীর পানি যখন কমে যায়, তখন চর পড়ে বা অন্যান্য কারণে পানি বেড়ে গেলে ভাঙন শুরু হয়। তাই নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো বছরের পরিকল্পনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে প্রকল্পভিত্তিক নদী ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। সেটি থেকে বের হয়ে এসে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে যেতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

ডেল্টা প্ল্যান অনুসারে সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি হলো নদীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো ফলপ্রসূ করা; দ্বিতীয়টি হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জনজীবন ও সম্পদ রক্ষা করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলীয় বাষ্পপূর্ণ আবহাওয়া এবং অসময়ে ভারী বৃষ্টির কারণে প্রতিবছর আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দিয়ে ব্যাপক পরিমাণ বালি ও পলি বাংলাদেশের নদীগুলোয় প্রবেশ করে। একই সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পলি ও বন্যার পানি মেঘনা বেসিনে পতিত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের নদীগুলোর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার এটি একটি কারণ। নদীগুলো বন্যার পানি ও পলি মাটি মেঘনা বেসিন হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে পারে না। যমুনা নদী দিয়েও বিপুল পরিমাণ পলি বন্যার পানির সাথে পরিবাহিত হয়। যমুনা নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমা হওয়ায় যমুনা অববাহিকার অধিবাসীরা দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ছে। এতে নদীর তলদেশের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে অতিবন্যার সৃষ্টি হয়।

বিশ্বের অন্যতম বন্যাপ্রবণ দেশ বাংলাদেশ। গত ৪০ বছরে এখানে বন্যায় মারা গেছে পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষ। ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। প্রতি চার থেকে পাঁচ বছর পর ভয়াবহ বন্যায় দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৯ হাজার ৭৩৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদ-নদী, বিল-ঝিল ও হাওর তথা মুক্তাঞ্চল। দেশের মোট ভূমির শতকরা ৮০ ভাগ প্লাবন ভূমি এবং ২০ ভাগ পাহাড়ি / উঁচু ভূমি। জলবায়ু বিবেচনায় বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আর্দ্রতা নাতিশীতোষ্ণ এবং শীত-গ্রীষ্মের বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ, যা সুস্পষ্ট ঋতুগত বৈচিত্র্য। প্রকৃতির এই বিচিত্র আচরণের ফলে বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং দেশের অধিকাংশ ভূমি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি নদীর পাড় ভাঙনের মুখে পড়ে; বিশেষত পাহাড়ি নদীগুলো ও হাওর এলাকায় বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ঢল নামে। হঠাৎ তীব্র স্রোত দেখা দেয় এবং নদীভাঙন শুরু হয়।

দেশে নদীভাঙনে নদীতে বিলীন হওয়া জমির (সিকস্তি) পরিমাণ ৫ লাখ ১৪ হাজার ৬৭১ দশমিক ৯৫ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিকস্তি জমি চট্টগ্রাম বিভাগে, যার পরিমাণ এক লাখ ৭৩ হাজার ১৬২ দশমিক ৯৩ একর।

সিইজিআইএস দেশের প্রধান তিনটি নদীর অববাহিকায় সম্ভাব্য ২০টি স্থান নির্বাচন করেছে, যা বর্তমান বছরে নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। এ ২০টি স্থানের মধ্যে ১৪টি যমুনা, ৫টি গঙ্গা ও একটি পদ্মা নদীতে। নদীভাঙনের ফলে প্রায় ১৩টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার মধ্যে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে।

ড্রেজিং শিল্পের বিবর্তন: নদ-নদীর নাব্য রক্ষাকল্পে ব্রিটিশ আমল হতেই এ উপমহাদেশে ড্রেজার ব্যবহূত হয়ে আসছে।  ২০০০ সালে তৎকালীন নেদারল্যান্ড সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি ৬ ইঞ্চি ড্রেজার উপহার হিসেবে প্রদান করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার চন্দনা বারাশিয়া নদী পুনর্খনন কাজের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের নদ-নদীর নাব্য রক্ষাকল্পে ড্রেজিংয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা ১১টি ড্রেজার ক্রয়ের নির্দেশনা দেন। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কুষ্টিয়া জেলায় গড়াই নদীর পাইলট সেকশনে ড্রেজিং করা হয়। ২০০০-০১ অর্থবছরে নেদারল্যান্ডের আর্থিক সহায়তা প্রকিউরমেন্ট অব ড্রেজারস অ্যান্ড এন্সিলারি ইকুইপমেন্ট ফর রিভার ড্রেজিং ফর ফ্লাড প্রটেকশন অব বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় এসডি শীতলক্ষ্যা-১৮, এসডি ব্রহ্মপুত্র-১৮, এসডি মহানন্দা-১৮, এসডি নবগঙ্গা-১৮ ও এসডি চিত্রা-১৮ ড্রেজার ক্রয় করা হয়।

দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভরাট হওয়া নদ-নদী পুনরুদ্ধার ও নাব্য রক্ষাকল্পে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীতব্য / গৃহীত নদীভাঙন রোধে তীর প্রতিরক্ষা কাজ সংবলিত প্রকল্পগুলোয় একটি নির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে নদী ড্রেজিং কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য অনুশাসন দিয়েছেন, যেন নদীতে জাগ্রত ডুবোচর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারিত হওয়ার ফলে নদীর প্রবাহ তীরে আঘাত করে নদীভাঙন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে।

ড্রেজার পরিদপ্তর কর্তৃক ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ৬৫ লাখ ঘনমিটার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৩৮ কিমি দৈর্ঘ্যে ৫০ লাখ ঘনমিটার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১০০.৮০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং সম্পাদন হয়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার আলোকে খননের মাধ্যমে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন মেয়াদে সুষ্ঠু পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, ভূমি পুনরুদ্ধার প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর স্বাভাবিক বন্যা হলে ড্রেজিংয়ের প্রায় ৪০ ভাগ পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হলে ড্রেজিংয়ের ৬০ ভাগ বালি এবং পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যায়। জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ভবিষ্যতে ড্রেজিংয়ের চাহিদা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

বিআইডব্লিউটিএ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৬২-৬৭ পর্যন্ত নেডেকোর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে নাব্য নৌপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ হাজার ৭৭০ কিলোমিটার। ১৯৮৭-৮৮ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে ৩ হাজার ৮২৪ কিলোমিটার।  ১৯৮৭-৮৮ সালে ডাচ ভিএইচবি কর্তৃক শ্রেণিবদ্ধ নৌপথ জরিপের পর প্রায় ৩৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে; কিন্তু নৌপথের জরিপ আর সম্পন্ন হয়নি। বর্তমান সরকারের গত ১০ বছরে পুনর্খননের কারণে নৌপথের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথকে নৌযান ও ফেরি চলাচল উপযোগী রাখতে বছরে অন্তত এক কোটি ঘনমিটার পলি অপসারণ করা দরকার। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩৫০০ কিলোমিটার নদীপথ সচল রাখতে ২০০ ড্রেজার প্রয়োজন; কিন্তু ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য আছে মাত্র ৩৫টি।

মেনটেইন্যান্স ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০০ লাখ কিউবিক মিটার পলি অপসারণের প্রোগ্রাম হাতে নেয় এবং ২০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়; কিন্তু বন্যায় জমা হওয়া ৪৫০ লাখ কিউবিক মিটার পলি অপসারণের জন্য অধিক অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। বিআইডব্লিউটিএর ৩৫টি ড্রেজার দিয়ে এ ধরনের কর্মসূচি সমাপ্ত করা কঠিন।

বর্তমানে ১৬টি নৌরুটে ৩৩টি ড্রেজার ড্রেজিং কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বিগত ১০ বছরে নদীর নাব্য রক্ষায় সরকার ২৫টি ড্রেজার সংগ্রহ করেছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি ড্রেজার দ্বারা ৪৭৪.৭৪ লাখ ঘনমিটার, বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা ৭০.৭০ লাখ ঘনমিটার এবং এক্সকাভেটর দ্বারা ২৫ লাখ ঘনমিটারসহ ৫৭০.৪৪ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করে এক হাজার ১৮০ কিলোমিটার নৌপথ নাব্য করা হয়েছে। সারা দেশে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য ২ হাজার ৩৮৬ কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ৫৩টি নৌরুটের ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের জন্য প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নদী খনন করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ২৯টি গুরুত্বপূর্ণ নদী খনন করার কথা রয়েছে। নদী খননের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল হবে।

বাংলাদেশ সরকার নদী ও নৌপথ উন্নয়নে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নদীর নাব্য রক্ষা, নদীর মাধ্যমে জলাধার সৃষ্টি ও নিরাপদ নৌপথ উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের সড়কের পরিবর্তে নৌপথ ব্যবহার করে পণ্য কার্গো পরিবহনে প্রতিবছর সাশ্রয় হয় ৭৫০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নদীর নাব্য রক্ষা ও নিরাপদ নৌপথ উন্নয়নে প্রতিবছর ড্রেজিং বাবদ ব্যয় হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে প্রায় ১৭০৩ কিলোমিটার নদীপথ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ১৩২০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়েছে এবং ৮২৩ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং হয়েছে।

বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথ। স্বাধীনতার পর বিআইডব্লিউটিএ যে জরিপ করে, তাতে দেখা যায় দেশের মোট আয়তনের ৭ শতাংশ নৌপথ। ১৯৭৫ সালে যেখানে দেশের মোট পরিবহন ক্ষেত্রে নৌপথে যাত্রী পরিবহন ছিল ১৬ শতাংশ ও মালামাল পরিবহন ৩৭ শতাংশ, ২০০৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮ ও ১৬ শতাংশে। সড়কপথের তুলনায় নৌপথে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ঝুঁকি অনেক কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নৌপথে ৩২৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২ হাজার ৪৫৫ জন। গড়ে প্রতি বছর ১৬৪ জন মারা গেছেন। সড়কপথে প্রতিবছর গড়ে ৪০০০ জন মারা যান। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে নৌপথ কমেছে প্রায় ১৮০০০ কিমি। নৌপথ সচল রাখতে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় না, ফসলি জমিও নষ্ট হয় না। পরিবেশ ও প্রতিবেশ উভয়ের জন্য নৌপথ সব সময়ই স্বস্তিদায়ক।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। যে হারে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাতে কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বড় অংশই তলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বর্ষায় বন্যা ও শীতকালে নদীগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ক্রমেই বাড়ছে। তাই অস্তিত্বের প্রয়োজনেই নদীগুলোকে ড্রেজিং করতে হবে। ড্রেজিং বা খনন শিল্প বাংলাদেশ বিকাশমান নতুন শিল্প। ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের ড্রেজিং শুরু হলেও বর্তমান সরকার এবং আগের মেয়াদে দুটি সরকারের সময়ে ড্রেজিং শিল্পের বিকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ড্রেজার ক্রয় এবং পরিচালনার কার্যক্রম আশার সঞ্চার করেছে। উদ্যোক্তারা বিপুল অর্থ ব্যয়ে ড্রেজার ক্রয়ের পর অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। অন্যদিকে ম্যাট্রিক্স সিস্টেমের সুবিধা নিয়ে বড় বড় ঠিকাদার অধিক কাজ হাতে নিয়ে নদীশাসনকে অনেক ক্ষেত্রে হুমকির মুখে ফেলছে। সরকার সম্প্রতি এ ধরনের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। সম্ভাবনাময় এ শিল্পের প্রসারে ড্রেজারে শিল্পবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও প্রণোদনা প্রদান জরুরি। ড্রেজিং শিল্পের উৎকর্ষ নদীশাসনে যুগান্তরকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ নদীশাসন ও নৌপথের নাব্য রক্ষায় কাজ করে। এ দুটি সংস্থাই ড্রেজিং কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতির চেহারা আমূল বদলে যাবে এবং নদীগুলোয় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র বৃদ্ধিসহ নৌপথে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে নৌপথে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে; ফলে অতিবন্যার সম্ভাবনা ও ঝুঁকি কম হবে। শুধু অতিবন্যা প্রতিরোধ করতে পারলেই জিডিপির ৩-৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে।  পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হলে নৌপথ হবে জনগণের নিরাপদ যাত্রার প্রথম পছন্দ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াও বিনোদনসহ বিনিয়োগের নতুন হটস্পট হতে পারে নদী। সেক্ষেত্রে ড্রেজিং শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি।

(তথ্য সূত্র : মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিবেদন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন)।

লেখক : উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/জেআই