Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

চট্টগ্রামের ফুসফুস রক্ষায় জনআকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন

মো. সোলেমান খান

জুলাই ১৮, ২০২১, ০৫:৪০ পিএম


চট্টগ্রামের ফুসফুস রক্ষায় জনআকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন
  • সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হাসপাতাল নির্মাণে যারা তড়িঘড়ি করছেন, তাদের আসলে উদ্দেশ্য কী? ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ বড় নয়, সামগ্রিক স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। দেশের নাগরিক হিসেবে কথা বলার অধিকার সবারই আছে। দেশের গুণীজনরা যেহেতু অন্য জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে, তাই সরকারকে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। চট্টগ্রাম নগরবাসীর সঙ্গে সারা দেশের মানুষই এ বিষয়ে একমত। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত দেশের আপামর মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন

সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের সংক্ষিপ্ত নাম সিআরবি। চট্টগ্রামের টাইগারপাস সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় এই ভবনে অবস্থিত। বন্দরনগরীর প্রাচীনতম ভবনটি ১৮৭২ সালে নির্মিত হয়। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসকরা নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। পরে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বেশকটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। সিআরবি এলাকায় এই ভবন ছাড়া আরও কিছু স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এগুলো হলো : চিত্রশালা, বাংলাদেশের প্রথম বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন, মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শিরীষতলা, সিআরবি মসজিদ, সিআরবি ভবনের প্রবেশদ্বার, সিআরবি সড়ক ও সবুজ মাঠ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কার্যালয় এলাকাকে সুশোভিত করে রেখেছে।

সিআরবি ভবন ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষের গাছপালা, পাহাড়-টিলা, আর দৃষ্টিনন্দন বাংলো। এছাড়া নগরীর মানুষের কাছে গাছগাছালি পরিবেষ্টিত শিরীষতলাসহ বিস্তীর্ণ জায়গা চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত। শতবছরের বৃক্ষ, পাহাড়, টিলা ও সবুজে ঘেরা এ এলাকাটি সব বয়সী মানুষের প্রাণ খুলে ঘোরা ও এক দণ্ড নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা। এই শিরীষতলা এখন পয়লা বৈশাখসহ বাঙালির প্রাণের মেলার অন্যতম স্থান। নগরবাসী সকাল-বিকাল এখানে ভ্রমণ করতে আসে।

২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট এই স্থানে প্রস্তাবিত ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি সিসিইএ সভার অনুমোদন দেয়া হয়। পরে ওই বছর ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চলতি বছরের শুরুতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয় সেখানে। তখন থেকেই নগরবাসীর মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

সিআরবি মোড় থেকে কদমতলী, টাইগারপাস সড়কসহ অন্যান্য শাখা-প্রশাখা সড়কের পাশে নানা প্রজাতির শতবর্ষী গাছ রয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ঐতিহ্যে স্থাপিত সিআরবি ভবনটি ইতিহাস ও স্থাপত্যকলায় ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা-গবেষণার উপজীব্য বিষয়। দেশের পরিবেশ বিধিমালা অনুযায়ী সিআরবি এলাকায় সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য নষ্ট করে অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ্জালাল মিশু তার এক প্রবন্ধে লেখেন, ২০১২ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিআরবিকে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। রেলওয়ে সদর দপ্তর ও এখানকার রেলওয়ে আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল।

সিডিএ সূত্রে জানা যায়, সিআরবির পুরো এলাকাকে এ প্রকল্পের আওতায় না এনে উন্মুক্ত শুধু সাত রাস্তার মোড়ে ২৫ একর জমির ওপর প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঠিক রেখে সিআরবির ছোট খালটিকে বাড়িয়ে কৃত্রিম লেক তৈরি, ফোয়ারা, কৃত্রিম ঝরনা, পাহাড়ে ওঠার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ, এক পাহাড়ের সঙ্গে অন্য পাহাড়ের সংযোগ তৈরির ফুট ওভারব্রিজ, লেকের ওপর কাঠের পাটাতনে বসার জায়গা, হাঁটাচলার জন্য দুই কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ও এর পাশে বসার জায়গা সৃষ্টি করা। ওয়াকওয়ে, রুফওয়ে, লেক, ঝরনা, ফুডকর্নারসহ আরও অনেক পরিকল্পনা ছিলো প্রকল্পটিতে। চট্টগ্রাম নগরবাসীর জন্য নান্দনিক নানা পরিকল্পনা অজ্ঞাত কারণে চট্টগ্রাম নগর উন্নয়ন কার্যালয়ে এখন ফাইলচাপা পড়ে আছে।

করোনার প্রথম ধাক্কায় আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেহাল দশা! দেশের দ্বিতীয় রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম। আবার বাংলাদেশের প্রধান বন্দরনগরীও চট্টগ্রাম। ব্রিটিশ আমলে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার সিআরবি। চট্টগ্রামে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত ভারসাম্যকে আগলে ধরে রেখেছে সিআরবি এলাকা।

ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ব্রিটেনের খ্যাতিমান আইনজীবী ও মানবাধিকার নেতা ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন, সরকার যদি তাকে সিআরবির বাইরে জায়গা দেয়, তাহলে তিনি ১০০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল তৈরি করে সরকারকে হস্তান্তর করবেন। শুধু শর্ত হবে গরিব মানুষ নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা পাবেন আর বড়লোকেরা এখানে অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা পাবেন।

ব্যারিস্টার মনোয়ার একজন আগাগোড়া দেশপ্রেমিক মানুষ। তার আকাঙ্ক্ষা ও সদিচ্ছার প্রতি আমরা সম্মান প্রদর্শন করে বলছি, মানুষ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে। প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক জায়গা বিনষ্ট করে উন্নয়ন কাজ করা অযৌক্তিক, অসাংবিধানিক। ইতোমধ্যে এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে। আদালত সংশ্লিষ্টদের রুলনিশি জারি করেছেন।

অপরদিকে দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, লেখক, ছাত্র, রাজনীতিবিদসহ আপামর জনগোষ্ঠী সিআরবি রক্ষা আন্দোলনে নেমেছেন। সবাই সিআরবিকে এক বাক্যে নগরীর ‘ফুসফুস’ বলে অভিহিত করেছেন। কারোই হাসপাতাল তৈরিতে অনীহা নেই, শুধু চান স্থান পরিবর্তন। বাংলাদেশ রেলওয়ের শত শত একর ভূমি রয়েছে সিআরবির বাইরে। সেখানে হাসপাতাল করে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে পারে সরকার। নতুন হাসপাতাল নির্মাণ বা পুরোনো হাসপাতাল সম্প্রসারণ করা এবং আধুনিকায়ন করার বিষয়ে কেউ আপত্তি করছে না বা আপত্তি করবে- এমনটাও নয়।

সরকার যখন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাবে, সেক্ষেত্রে ওই এলাকায় সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের পেশাজীবীর মতামত নেয়া প্রয়োজন ছিলো। পরিকল্পনা অনেক পুরোনো। তবে কেন সংশ্লিষ্টরা এতদিন বিষয়টি জনসমক্ষে আনেননি, তা বোধগম্য নয়। এ ধরনের হঠকারিতার জন্য সরকারের ভেতরে-বাইরে অনেক সুবিধাবাদী তৎপর রয়েছে। তাই সরকারকে ভেবেচিন্তেই কাজ করা উচিত। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। সেখানে ইপিজেড এলাকায় ৫ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। পতেঙ্গায় সমুদ্রতীরের কাছে শত শত একর ভূমি রয়েছে। সেখানে একটি বিশাল হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করতে বাধা থাকার কথা নয়।

সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ যেমন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, ঠিক তেমনি রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরাও সিআরবিকে ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণ ভালো চোখে দেখছেন না। তারাও ভালো মানের হাসপাতাল চান; তবে অন্য কোনো স্থানে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হাসপাতাল নির্মাণে যারা তড়িঘড়ি করছেন, তাদের আসলে উদ্দেশ্য কী? ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ বড় নয়, সামগ্রিক স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। দেশের নাগরিক হিসেবে কথা বলার অধিকার সবারই আছে। দেশের গুণীজনরা যেহেতু অন্য জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে, তাই সরকারকে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। চট্টগ্রাম নগরবাসীর সঙ্গে সারা দেশের মানুষই এ বিষয়ে একমত। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত দেশের আপামর মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আমারসংবাদ/জেআই