Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

সড়ক দুর্ঘটনা কি অপ্রতিরোধ্য

ইমরান হুসাইন

জুলাই ২৬, ২০২১, ০৬:৫৫ পিএম


সড়ক দুর্ঘটনা কি অপ্রতিরোধ্য
  • সড়ক দুর্ঘটনা রোধ যত জটিলই হোক না কেন, সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই এর সমাধানে এগিয়ে এলে ব্যাপক দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এজন্য সবাইকে সড়কে সতর্কতা অবলম্বন করে চলাচলের পাশাপাশি যথাযথ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে

সড়ক দুর্ঘটনা যেন আমাদের দেশে এখন খুবই স্বাভাবিক এক বিষয় হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কারও মধ্যে নেই কোনো সচেতনতা, নিয়মানুবর্তিতা। অবাধে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে সড়কে। এমন সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নেই কোনো জোরালো পদক্ষেপ। আমরা যারা এমন ঘটনার শিকার হইনি, তারা বোধ হয় দূর থেকে এ ব্যথাটা অনুভব করতে পারি না। কিন্তু যার চলে যায়, সে-ই বোঝে আপনজন হারানোর বেদনা।

বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের ও পরিবারের সবার দুই বেলার আহার জোগাতে সকাল থেকেই শুরু হয় মানুষের কর্মব্যস্ততা। আর এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেই ঘটে যায় নানা রকম অঘটন। যার মধ্যে অন্যতম হলো সড়ক দুর্ঘটনা। নিরাপদ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা সার্বক্ষণিক হুমকিস্বরূপ কাজ করে সাধারণ মানুষের মনে। বর্তমানে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে নির্বিবাদে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তারপরও নেই সঠিক ব্যবস্থাপনা বা জনসচেতনতা।

কালে কালে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি হলেও দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়েই চলেছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে রাস্তায় চলাচলকারীদের। প্রতিটি ক্ষণই থাকতে হয় আতঙ্কে- এই বুঝি গাড়ি উঠে গেলো গায়ের ওপর! এই বুঝি আর বাড়ি ফেরা হলো না! একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাই যে, প্রতিনিয়তই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা দ্রুতই বেড়ে চলেছে। সড়ক নয়, যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ।

সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জরিপে উঠে এসেছে চলতি বছরের গত জুন মাসে দেশে ৩২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৪২৩ জন। মে মাসের তুলনায় জুনে সড়ক দুর্ঘটনা কম। মে মাসে ৪৪১ দুর্ঘটনায় ৫৬২ জন মারা যান। গড়ে প্রতিদিন মারা  গেছেন ১৮.১২ জন। জুন মাসে প্রতিদিন মারা যান ১৩.২৬ জন। তবে জুন মাসের অর্ধেক সময়জুড়ে এলাকাভিত্তিক লকডাউনে বিভিন্ন জেলা শহরে যানবাহন বন্ধ ছিলো এবং ২৮ জুন থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ ছিলো বলে সড়ক দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা কম। জরিপে দেখা গেছে, সড়কে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি হয়ে উঠেছে মোটরসাইকেল ও ট্রাক। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরবাইক চালানোর ফলে তারা নিজেরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি সমন্বিত টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। জরিপে আরও দেখা গেছে, জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৫২ জন নারী ও ৩৩ শিশু রয়েছে। ১৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫২ জন মারা যান, যা মোট মৃত্যুর ৩৭.৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৪২ শতাংশ। এ সময়ে দুর্ঘটনায় ৯৪ পথচারী নিহত হন। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হন ৬৭ জন। গত জুনে দুটি নৌ-দুর্ঘটনায় দুজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন।

এ ছাড়া একটি রেলপথ দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, ফাউন্ডেশন সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংগত কারণেই এ সমস্যা থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।

প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে তরতাজা প্রাণ। মুহূর্তেই খালি করে দিচ্ছে কোনো না কোনো মায়ের কোল। অনেকেই আবার বেঁচে থাকছেন পঙ্গু হয়ে। ভুগতে হচ্ছে সারা জীবন। তাই তো বলে ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’। কেউ যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে তাকে হারিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার পরিবারের সদস্যদের। আর যদি তিনি আহত অবস্থায় থাকেন, তাহলেও সবাইকে ভুগতে হয়। আর এসব দুর্ঘটনার পেছনে নেই কোনো একক কারণ। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে আছে নানাবিধ কারণ। যেমন- ১. অতিরিক্ত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য গাড়ির চালক গতি বাড়িয়ে দেন। ফলে সামনে থাকা অন্য গাড়িকে অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় ধাক্কা লেগে যায়। এমনকি গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে পথচারীকে চাপাও দিয়ে দেয় কিছু টালমাটাল চালক। সড়কে কিছু চালক আছেন যারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে সড়ক দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটান। পুলিশের বেশিরভাগ রিপোর্টে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যায় গাড়ির অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মনোভাব। ২. সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হচ্ছে অনুন্নত সড়কব্যবস্থা। বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণ উন্নত নয়। এছাড়া আমাদের দেশের যানবাহনের তুলনায় রাস্তাও পর্যাপ্ত নয়। ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চল এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কগুলো খুবই ব্যস্ত। ফলে এসব সড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা। তবে সরকার এই সড়কগুলো চার লেন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা সম্পন্ন হলে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। ৩. বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অদক্ষ চালক। আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকেরই নেই যথাযথ প্রশিক্ষণ। এদের মধ্যে আবার অনেকেরই নেই লাইসেন্স। আবার অনেকে হেলপার থেকে ড্রাইভার হয়ে থাকেন। অনেক চালক আছেন যারা একেবারেই অদক্ষ এবং ট্রাফিক আইনের বিষয়েও অজ্ঞ। যে কারণে গাড়ি চালানোর সময় তারা মোবাইল ফোনে কথা বলেন; আবার ফুল ভলিউম দিয়ে গান শোনার কারণে আশেপাশের ঘটনা বা কোনো গাড়ির সংকেত বা হর্ন তারা শুনতে পান না। আবার অনেক চালকের গাড়ি চালানোর পর্যাপ্ত বয়সও হয়নি বা শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা ছাড়াই চালকরা গাড়ি চালিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে অকালে ঝরিয়ে দেন তাজা প্রাণ। ৪. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ। আমাদের রাস্তাঘাটের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বহুদিনের পুরোনো যানবাহনের সংখ্যাই বেশি। সব থেকে বড় কথা, এদের অধিকাংশের ফিটনেস সার্টিফিকেটও নেই। প্রশাসন এগুলোকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করার পরও ওইসব যানবাহন সড়কে চলাচল করছে এবং বড় বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। ৫. অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেক কারণ। বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। আর জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে যানবাহনও। জনসংখ্যা বাড়ছে, যানবাহন আছে কিন্তু বাড়ছে না সে তুলনায় সড়কের প্রশস্ততা বা বিকল্প কোনো উপায়। যে কারণে দীর্ঘ সময় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। আর ব্যস্ততার কারণে চালকরা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করছেন।

কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে শুধু যে চালকরাই দায়ী বা সব সময় যে চালকদেরই দোষ- তা কিন্তু নয়। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে আছে যাত্রী বা পথচারীদের অসাবধানতা বা অজ্ঞতা। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে দ্রুত গতিতে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পথচারীরা ট্রাফিক আইন বা জেব্রা ক্রসিং না মেনেই এলোমেলো চলাচল করেন; আবার কখনও বাস বা ট্রাকের ছাদে উঠে অস্বাভাবিক আচরণে লিপ্ত হন; যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। যাত্রী বা পথচারীদের এমন বেপরোয়া আচরণ প্রতিহত করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই তাদের এমন আচরণের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাবে শুধু তাজা প্রাণ নষ্ট হয় না; বরং শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা যেভাবেই হোক না কেন, তার ফল সব সময় ভয়ঙ্কর। মানবসম্পদের বিনাশ এই সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ক্ষতি। দুর্ঘটনাকবলিত একটি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে হাহাকার করে থাকে। তাদের এই ক্ষতি অপূরণীয়। কোনোভাবেই তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। আর যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি এ রূপ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রভাব পড়ে দীর্ঘদিন ধরে।

সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো বিশাল সমস্যা নয়- যদি আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি মেনে চলি। সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে প্রত্যেকের অধিক সচেতনতা বা সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যেমন : চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রকৃত লাইসেন্সধারীরাই গাড়ি চালান কি না, তা যাচাই করে দেখা। চলন্ত অবস্থায় চালকদের সাথে কথা না বলা এবং অভারটেকিং প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকা। অতি পুরোনো গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা। ব্যস্ততম জায়গাগুলোয় ফুট ওভারব্রিজ বা নিরাপত্তা জোরদার করা। ট্রাফিক বা সড়ক নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সবাইকে অবগত রাখা।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ যত জটিলই হোক না কেন, সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই এর সমাধানে এগিয়ে এলে ব্যাপক দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এজন্য সবাইকে সড়কে সতর্কতা অবলম্বন করে চলাচলের পাশাপাশি যথাযথ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই