Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

মুসলমানদের কিবলা পবিত্র কাবার ইতিহাস

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জুলাই ২৯, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


মুসলমানদের কিবলা পবিত্র কাবার ইতিহাস

মসজিদ আল-হারাম ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। মুসলিমরা নামাজের সময় কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। হজ্জ ও উমরার জন্যও মসজিদুল হারামে যেতে হয়। মসজিদ আল-হারামের ধারণক্ষমতা ৯,০০,০০০ মুসল্লি (হজ্জের সময় ৪০,০০,০০০ তে উন্নীত হয়)। মিনার রয়েছে ৯টি। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৮৯ মিটার (২৯২ ফুট)। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ) দুজন একত্রে কাবা নির্মাণ করেন। ইবরাহিম (আ) কাবার পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ পাথর স্থাপন করেছিলেন যা হাদিস অনুযায়ী বেহেশত থেকে আগত। এই পাথর একসময় দুধের মত সাদা ছিল, কিন্তু মানুষের গুনাহর কারণে এটি কালো হয়ে পড়ে। ইবরাহিমের (আ) নির্মিত কাবার মধ্যে এই পাথরটিই একমাত্র আদি বস্তু হিসেবে টিকে রয়েছে। কাবা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিমকে (আ) হজ্জের জন্য আহবান করতে আদেশ দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে “আর মানুষের কাছে হজ্জ ঘোষণা করে দাও, ওঁরা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও ধাবমান উটের পিঠে চড়ে, আসবে দুরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে” (সূরা হজ্জ, ২৭)।

কাবা ২১৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে নির্মিত হয় বলে বর্ণিত আছে। কাবাই পৃথিবীর প্রথম ইবাদতের স্থান। প্রাথমিকভাবে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হলেও কালক্রমে কাবায় পৌত্তলিকতার চর্চা শুরু হয়। মক্কা বিজয়ের আগে এখানে ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল। রাসুলের (সা) মক্কা বিজয়ের পর কাবার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ফলে কাবায় পৌত্তলিকতার চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মসজিদুল হারামের নির্মাণ বিভিন্ন সময়ে সম্পাদিত হয়। ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে প্রথম বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এর পূর্বে মসজিদ ছিল কাবাকে কেন্দ্র করে একটি খোলা স্থান। সংস্কারে ছাদসহ দেয়াল দিয়ে এলাকাটি ঘিরে দেয়া হয়। ৮ম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মসজিদের পুরনো কাঠের স্তম্ভগুলোর বদলে মার্বেলের স্তম্ভ স্থাপন করা হয় এবং নামাজের স্থান বৃদ্ধিসহ মিনার যুক্ত করা হয়। ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে হাজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদে আরো সংস্কার করা হয়। ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় সেলিম প্রধান স্থপতি মিমার সিনানকে মসজিদ পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। এই পুনর্নির্মাণের সময় সমতল ছাদগুলোর বদলে ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত গম্বুজ ও নতুন স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এগুলো বর্তমান মসজিদের সবচেয়ে পুরনো প্রত্ননিদর্শ?ন। ১৬২১ ও ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কাবা ও মসজিদ আল হারামের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান চতুর্থ মুরাদের শাসনামলে কাবা পুনর্নির্িমত হয় এবং মসজিদ আল হারাম সংস্কার করা হয়। মসজিদ সংস্কারের সময় পাথরের নতুন খিলান নির্মিত হয় এবং তিনটি নতুন মিনার যুক্ত করা হয়। মেঝেতে মার্বেলের আচ্ছাদন নতুন করে স্থাপিত হয়। এরপর প্রায় তিনশত বছর মসজিদের রূপ অপরিবর্তিত ছিল।

সৌদি শাসন শুরু হওয়ার পর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বড় আকারের সংস্কার সাধিত হয়। এসময় আরো চারটি মিনার যুক্ত করা হয়, ছাদ সংস্কার করা হয় এবং মেঝে পাথর ও মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। সাফা ও মারওয়াকে এসময় মসজিদের দালানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংস্কারের সময় উসমানীয় যুগের অনেক অংশ বাদ দেয়া হয়েছিল। বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের শাসনামলে দ্বিতীয়বার সংস্কার করা হয়। এসময় নামাজের নতুন স্থান এবং বাইরে নামাজ পড়ার স্থান যুক্ত করা হয়। এই নতুন অংশে কিং ফাহাদ গেট দিয়ে প্রবেশ করা যায়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৃতীয় সৌদি সমপ্রসারণ সম্পন্ন হয়। এসময় আরো মিনার যুক্ত করা হয়। সে সাথে আরাফাত, মিনা, মুজদালিফাতেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। তৃতীয় সমপ্রসারণে ১৮টি নতুন ফটক যুক্ত করা হয়, প্রায় ৫০০টি মার্বেল স্তম্ভ যুক্ত করা হয়, তাপ নিয়ন্ত্রিত মেঝে, এয়ার কন্ডিশন, চলন্ত সিড়ি ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যুক্ত হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ আল হারামের চতুর্থ সমপ্রসারণ কার্য? শুরু হয় যা ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শেষ হয়। তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ২০ লক্ষে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি সালমান বিন আবদুল আজিজ এই সমপ্রসারণ চালু রেখেছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর সমপ্রসারণের সময় ব্যবহূত একটি ক্রেন ঝড়ে ভেঙে পড়ায় ১১১ জন মুসল্লী মারা যান।

কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিন করেন।

কাবা একটি বড় পাথরের কাজ করা কাঠামো যার আকৃতি প্রায় একটি ঘনকের মত। কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকা’আব অর্থ ঘন থেকে। কাবার পূর্ব কোনা হচ্ছে রুকন-আল- আসওয়াদ” (কাল পাথর অথবা “আল-হাজারুল-আসওয়াদ”), একটি উল্কাপিন্ডের অবশেষ; উত্তর কোনা হল “রুকন-আল-ইরাকী” (ইরাকী কোণ); পশ্চিমে রয়েছে “রুকন-আল-সামী” (পূর্ব-ভূমধ্য সাগরীয় কোণ) এবং দক্ষিণে “রুকন-আল-ইয়ামানী” (‘ইয়েমেনী কোণ’)। কাবা কালো সিল্কের উপরে স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি করা কাপড়ের গিলাফে আবৃত থাকে। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে পরিচিত; যা প্রতিবছর পরিবর্তন করা হয়। কালেমা শাহাদাত এ কাপড়ের মধ্যে সুতা দিয়ে লিখার কাঠামো তৈরি করা হয়। এর দুই তৃতীয়াংশ কোরানের বাণী স্বর্ণ দিয়ে এম্রোয়ডারি করা হয়।

বর্তমানে গিলাফ কালো রেশমী কাপড় নির্মিত, যার ওপর স্বর্ণ দিয়ে লেখা থাকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ”, “আল্লাহু জাল্লে জালালুহু”, “সুবহানাল্লাহু ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযিম” এবং “ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান”। ১৪ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৫ সেমি প্রস্থ ৪১ খ্ল বস্ত্রখ্ল জোড়া দিয়ে গিলাফ তৈরি করা হয়। চার কোণায় সুরা ইখলাস স্বর্ণসূত্রে বৃত্তাকারে উৎকীর্ণ করা হয়। রেশমী কাপড়টির নিচে মোটা সাধারণ কাপড়রের লাইনিং থাকে। একটি গিলাফে ব্যবহূত রেশমী কাপড়ের ওজন ৬৭০ কিলোগ্রাম এবং স্বর্ণের ওজন ১৫ কিলোগ্রাম। বর্তমানে এটি তৈরীতে ১৭ মিলিয়ন সৌদী রিয়াল ব্যয় হয়। কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন কখন বা কার উদ্যোগে শুরু হয় সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। একটি ঐতিহাসিক সূত্রানুযায়ী নবী হযরত ইসমাঈল (আ.) প্রথম পবিত্র কাবা শরীফকে গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করেন। অন্য বর্ণনায় আছে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ব পুরুষ আদনান ইবনে আইদ পবিত্র কাবা শরীফকে প্রথম গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদই সম্ভবতঃ পবিত্র কাবা শরীফ গিলাফ আচ্ছাদনকারী প্রথম ব্যক্তি। রাসুলের (সা.) মদীনা হিজরতের ২২০ বৎসর আগে হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদ এই শহরটিতে (ইয়াসরিব) আক্রমণ করেন। তুব্বা আবু কবর আসাদ ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত: মাথা মু্লন করেন। অত:পর তিনি এই শহরে কয়েকদিন অবস্থান করেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি ঘুমের মধ্যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন

যে তিনি কাবা শরীফ গিলাফ দ্বারা আচ্ছাদন করছেন। এ স্বপ্ন দ্বারা প্রাণিত হয়ে অবিলম্বে “খাসাপ” দ্বারা কাবাঘরটি আচ্ছাদিত করেন। “খাসাপ” হচ্ছে তালগাছ জাতীয় গাছের পাতা ও আঁশের তৈরি এক ধরনের মোটা কাপড়। অনন্তর তিনি আবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি আরো উন্নতমানের কাপড় দ্বারা কাবা শরীফ আচ্ছাদন করছেন। অত:পর তিনি খাসাপের পরিবর্তে মামিজিয়ান, পাপিরাস (মিশর দেশীয় নলখাগড়া বিশেষ পাতা) দ্বারা কাবা ঘর আচ্ছাদন করেন। ইয়েমেনের মামিজ নামক একটি উপজাতীয় গোত্র এই কাপড় তৈরি করতো। এরপরও তৃতীয়বারের মতো তিনি স্বপ্নে আরো উন্নত মানের কাপড় দ্বারা কাবা আচ্ছাদনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তৃতীয় দফা স্বপ্নটির পর তিনি ইয়েমেনের লাল ডোরাকাটা কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবা ঢেকে দিয়েছিলেন। তুব্বা আবু কবরের রীতি অনুযায়ী মক্কার স্থানীয় লোকজন সুন্দর কাপড় বা গিলাফ দিয়ে পবিত্র কাবাঘর আচ্ছাদন করতে থাকে এবং তা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়। বর্তমানে দামী কালো রং সিল্কের কাপড়ের তৈরি স্বর্ণখচিত ক্যালিগ্রাফি মোটা গিলাফ দিয়ে কাবা শরীফ আচ্ছাদন করা হয়। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে আখ্যাযতি। আব্বাসীয় খলিফা আল আব্বাস আল মাহদী ১৬০ হিজরীতে পবিত্র হজ্জ পালনকালে পবিত্র কাবা থেকে একটি ছাড়া সবগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। এখনো এই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। ৭ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের আগে মুহম্মদ (সা:) গিলাফ পরানো শুরু করেননি। অত:পর গিলাফ পরানোর সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে। বাদশাহ বাইবার্স হচ্ছেন পবিত্র কাবায় গিলাফ পরিয়ে দেয়া প্রথম মিশরীয় শাসক। তারপর ইয়েমেনের বাদশা আল মুদাফ্ফার ৬৫৯ হিঃ কাবা শরীফে গিলাফ পরান। পরবর্তীতে মিসরের শাসকরা পর্যায়ক্রমে এ কাজ অব্যাহত রাখেন। বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সউদ মক্কা-মদীনার দুই পবিত্র মসজিদের দেখাশোনার দাযত্বিভার গ্রহণের পর ১৩৪৬ হিজরিতে কাবা শরীফের গিলাফ তৈরির জন্য একটি বিশেষ কারখানা স্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন। একই বৎসর মাঝামাঝি সময়ে প্রয়োজনীয় কাপড় তৈরি করে মক্কার দক্ষ শিল্পীর মাধ্যমে তা সুন্দর নকশায় সুসজ্জিত করে কাবা শরীফ আচ্ছাদিত করা হয়। ১৩৫৭ হিজরী পর্যন্ত এই কারখানাটি গিলাফ বা “কিসওয়াহ” তৈরি অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ১৩৮১ হিজরীতে সৌদি হজ্জ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষ সৌদি কারিগর দ্বারা রেশমী ও সোনালী সুতা দিয়ে গিলাফ তৈরি করে কাবার গায়ে পরিধানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩৮২ হিজরীতে বাদশাহ ফয়সাল ইবনে আব্দুল আজিজ নতুন ডিক্রিজারির মাধ্যমে নতুন করে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। খাঁটি প্রাকৃতিক রেশমী রং-এর সাথে কালো রং-এর কাপড় দিয়ে পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে কুরআনের কিছু আয়াত শোভা পায়। অক্ষরগুলো সোনালী আভায় উদ্ভাসিত। প্রতি বৎসর হজ্জের ঠিক আগে কাবা শরীফের গিলাফ সরিয়ে তা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হাজীদের ইহরামের শ্বেতশুভ্রতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাদা গিলাফ পরানো হয়। হজ্জ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১০ জিলহজ্জ তারিখে নতুন গিলাফ পরানো হয়। আর পুরাতন গিলাফটি খণ্ড খণ্ড করে বিলিয়ে দেয়া হয়।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই