Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে ইসলাম

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

আগস্ট ৫, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে ইসলাম

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, যেমন- পশু-পাখি, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, আলো-বাতাস, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা, অফিস-আদালত, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি সবকিছু মিলে আমাদের পরিবেশ। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের বসবাসের জন্য এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য ও ভারসম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করছেন। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য যাবতীয় উপাদান উপকরণ মিলেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তাই মানবীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই পরিবেশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। 

পরিবেশ সংরক্ষণ বলতে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক বিষয়গুলো প্রকৃত অবস্থায় রক্ষা করা অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালা এই জগতকে যেভাবে সাজিয়েছেন ঠিক সেভাবে সংরক্ষণ করাকে পরিবেশ সংরক্ষণ বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন- মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নির্মাণ করেছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দর বিকাশের জন্যে যেমন পরিবেশ প্রয়োজন আল্লাহ তায়ালা তেমন পরিবেশই দিয়েছেন। যে জন্য পরিবেশের পরিবর্তন বা যে কোন রকমের বিকৃতি জীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনে। গাছ-পালা, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-উপসাগর এবং বিভিন্ন জলজ, বনজ ও খনিজ সম্পদ নিয়ে পরিবেশ তার স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। মানুষ নির্বিচারে গাছ কেটে, পাহাড় কেটে, নদীনালার নাব্যতা নষ্ট ও গতি পরিবর্তন করে, সাগর-উপসাগর দূষিত করে, অবিবেচকের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার করে, বায়ূ দূষণ করে পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনে। অথচ গাছ-পালা, বন-জঙ্গল মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গাছ হলো মানুষের মহা উপকারী বন্ধু। অর্থনৈতিক ভূমিকা ছাড়াও অক্সিজেন সরবরাহ, প্রাকৃতিক ভারসম্য রক্ষা, জ্বালানি ও কাঠ যোগান দিয়ে এবং প্রাকৃতিক মহামারি ও দুর্যোগ  প্রতিরোধ করে গাছপালা মানুষের অপরিসীম উপকার সাধন করে।

পাহাড়-পর্বত রক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসম্য। নদী-নালা, সাগর, উপসাগর, পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখে। তাছাড়া মানুষের আমিষের অভাব মেটায় জলজ সম্পদ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা ব্যাপক। এ সব কারণে নিজেদের কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার স্বার্থে মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু নানা কারণে পরিবেশ আজ দারুণ হুমকির মুখে। জমি, বনভূমি, খনি, জলস্রোত প্রায় দুই শত কোটি হেক্টর জমির উর্বর স্তর ক্ষয় হয়ে গেছে। পানি, বাতাস ও স্থলে প্রতি বছর মিশে যাচ্ছে প্রায় তিনশ কোটি টনের বেশি ক্ষতিকর পদার্থ। পৃথিবীর বায়ু স্তরে প্রতিবছর জমছে প্রায় দুই শত মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড। কলকারখানার ধোঁয়ার সাথে মিশছে প্রায় একশ ষাট মিলিয়ন নাইট্রিক এসিড। প্রতিদিনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নতুন নতুন শিল্প কারখানা, মোটরগাড়ি থেকে বিমান পর্যন্ত সব যানের পোড়া জ্বালানি একদিন পৃথিবীকে হয়তো উদ্ভিদশূন্য করে ছাড়বে। শিল্পবর্জ, পারমাণবিক বর্জ্য ও অস্ত্রপরীক্ষা, নানারকম যুদ্ধাস্ত্র তৈরি ও তার ব্যবহার পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমেই মানুষ বাসের অনুপযোগী করে তুলছে।

এমনি নাজুক পরিস্থিতিতে পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষকেই এগিয়ে আসতেই হবে। তা না হলে পৃথিবীতে একদিন মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। এ জন্য মানুষের করণীয়গুলো হচ্ছে- ১. পরিবেশ দূষণ দূর কর: পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের প্রথম দায়িত্ব হলো পরিবেশ দূষণ রোধ করা। এ জন্য ব্যবহূত শিল্প ও পারমাণবিক বর্জ্য সতর্কতার সাথে নষ্ট করে দিতে হবে। খোলা পায়খানা, যত্রতত্র ময়লা ফেলা ও মলমুত্র ত্যাগ বন্ধ করতে হবে। নির্বিচারে গাছ কাটা ও অপরিকল্পিত আবাসন স্থাপন নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে গাছ লাগানোর উৎসাহ দিয়ে সামাজিক বনায়ন জোরদার করবে। হাদীস শরীফে এসেছে- রাসূল (সা.) বেশী বেশী বৃক্ষরোপণ করার তাগিদ দিয়েছেন। বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন কিংবা পাতা ছিঁড়তে নিষেধ করছেন। রাসূল (সা.) বলেন- প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। কাজেই আমাদেরকে বৃক্ষ নিধন ও পাতা ছেড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এক কথায় কমপক্ষে ২৫% ভূমি বনায়নে রূপান্তরিত করতে হবে। ২. বায়ু দূষণ রোধ: দূষিত বাতাস মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশুদ্ধ বাতাস ছাড়া মানুষের সুস্থ জীবন যাপন অসম্ভব। কল কারখানা, ইটভাটা, সিগারেট এবং গাড়ির ধোঁয়া দিয়ে মানুষ বায়ুকে দূষিত কবে চলছে। মানুষ তাই কালো ধোঁয়া সৃষ্টিকারী কলারখানা মোটরগাড়ি ব্যবহার করবে না। পরিকল্পিত শিল্পকারখানা স্থাপন করে বায়ু দূষণ রোধ করবে। ৩. শব্দ দূষণ রোধ: শব্দ দূষণ জনস্বাস্থ্য নষ্ট করে, শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করে। আবাসিক এলাকায় কল-কারখানা স্থাপন, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি চালনা, অহেতুক হর্ণ বাজানো, মাইক ও মিউজিক সিস্টেমে উচ্চ শব্দে গান বাজানো শব্দ দূষণের প্রধান কারণ। শব্দ দূষণ রোধে মানুষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। নিজে দূষণ সৃষ্টিকারী কাজ থেকে বিরত থাকবে। অন্যকে এ থেকে বিরত রাখবে। এ সংক্রান্ত আইন করে রাষ্ট্র তা প্রয়োগের কার্যকর উদ্যোগ নেবে। ৪. পানি দূষণ : পানি মানব জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। পানি ছাড়া কোন প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ জীবন ধারণ করতে পারে না। এ জন্য পানির অপর নাম জীবন। তবে সে পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে। কেননা বিশুদ্ধ পানি যেমন জীবন ধারণের প্রধান উপাদান তেমনি দূষিত পানি জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। তাই পানি দূষিত করা কোন মতেই ঠিক নয়। পানিতে গৃহস্থলি, কল-কারখানার ময়লা আবর্জনা ফেলা, বদ্ধ পানিতে ময়লা জিনিস ধৌত করা, এমনকি অপবিত্র শরীর নিয়ে গোসল করাও ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন- এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে পানি তুলে গোসল করবে। ৫. প্রকৃতির ভারসম্য রক্ষা: প্রকৃতির ভারসম্য রক্ষা করা পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের মূল দায়িত্ব। এ জন্য মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটবে না। পাহাড়-পর্বত কেটে সমান করবে না। বরং পাহাড়কে তার প্রকৃত অবস্থায় রেখে তাতে প্রচুর গাছ লাগানো উদ্যোগ নেবে। প্রয়োজনীয় বনভূমি গড়ে তুলবে। পাশাপশি গড়ে তুলবে সবুজ বাসগৃহ। বসতবাড়ির চারপাশে গাছ লাগাবে। রাসায়নিক বর্জ্য ও অপরিশোধীত তেল ছড়িয়ে সাগরের পরিবেশ নষ্ট করবে না। নদীকে শিল্প বর্জ্য থেকে দুষণ মুক্ত রাখবে। তার নাব্যতা রক্ষার ব্যবস্থা নেবে। পরিকল্পিত বনায়ন ও বৃক্ষরোপন অব্যহত রেখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করবে। এ জন্য মানুষ সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলবে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে গণসচেতনতা সৃষ্টি করবে। মানুষের জন্য সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ সংরক্ষণের এই যে উদ্যোগ ইসলামী আদর্শ হতে পারে এবার নেপথ্যে প্রেরণা। রাসূল (সা.) বনায়নের ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ দিয়েছেন। প্রকৃতিকে নিজস্ব অবস্থার উপর রাখার গুরুত্ব দিয়েছেন।

পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতেও ইসলামের তাকিদ রয়েছে। পরিবেশ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে আদ জাতির পরে প্রতিনিধি করেছেন; তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ কর এবং পর্বত গাত্র খনন করে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ কর। অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না’’ (সূরা আরাফ, ৭৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না” (সূরা বাকারা, ১৯৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে’ (সূরা রুম, ৪১)। পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। কোরআনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও’ (সূরা বাকারা, ২২২)।

কুরআন মাজিদের অনেক সূরার নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও খনিজসম্পদের নামে। যেমন- গরু, হাতি, মাকড়সা, মৌমাছি, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি। পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য আসমান থেকে আল্লাহ বর্ষণ করেন স্বচ্ছ পবিত্র পানি। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা পৃথিবীকে মৃত্যুর পর সজীব করেন। প্রত্যেক প্রকারের জীবজন্তুর বিস্তৃতি ঘটান। আসমান ও জমিনের মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত বায়ু ও মেঘ পানির পরিবর্তনে জ্ঞানী সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শন বিদ্যমান’ (সূরা বাকারা, ১৬৪)।

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দাবিতে দুনিয়া জুড়ে আজ সম্মিলিত আওয়াজ উঠেছে। মানুষের অদূরদর্শিতা এবং অমানবিক আচরণের কারণে প্রাকৃতিক যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে তা গোটা বিশ্বের মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে বায়ুতে বেড়েছে দূষণ, বেড়েছে তাপমাত্রা, বৃদ্ধি পেয়েছে রোগ-শোক এবং প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বন রক্ষা এবং বৃক্ষ রোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অথচ মহানবী (স.) বৃক্ষ বা বন রক্ষার তাগিদ দিয়ে গেছেন সেই চৌদ্দশত বছর আগে। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করতে রাসূল (স.) মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিড়লে রাসূল (স.) বললেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’ বৃক্ষ রোপণকে উৎসাহিত করেছেন মহানবী (স.)। গাছ-পালা, লতা-পাতা মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। সব নবী-রাসূল প্রকৃতি ও পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি সংরক্ষণ করেছেন এবং তার অনুসারীদের উৎসাহিত করেছেন।

প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়ে বাঁচতে পারে, মানুষ পারে না। এমনিভাবে প্রকৃতির মধ্যেও আছে রকমভেদ। প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্র পৃথিবীর মূল সম্পদ হলো ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। আর পরিবেশ বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ অমূল্য বৃক্ষ ছাড়া কল্পনা করা অবান্তর। তাই ইসলাম এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী নির্দেশনা প্রদান করেছে।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই