Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মৃত্যু বিপদে গর্ভবতীরা

আগস্ট ১৩, ২০২১, ০৭:২৫ পিএম


মৃত্যু বিপদে গর্ভবতীরা
  • গর্ভবতীদের প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন ও আইসিইউ শয্যা কম
  • ইমার্জেন্সি করোনা টেস্ট ও রিপোর্ট পাওয়ার ভোগান্তিতে ক্ষোভ
  • করোনার ভয়ে গত বছর আড়াই লাখেরও বেশি চিকিৎসা নেননি
  • গর্ভপাত করিয়েও মায়েদের বাঁচানো যাচ্ছে না- বলছেন চিকিৎসকরা
  • অপারেশনের জন্য ঢামেক ও মুগদায় বিশেষ সেবাকেন্দ্র
  • মা ও সন্তানকে বাঁচাতে আইসিইউ ছাড়া উপায় নেই

সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় গর্ভের সন্তানের মৃত্যুর পর করোনায় মারা যান রহিমা খাতুন। ৯ মাসের সন্তানসম্ভবা অবস্থায় করোনা পজেটিভ হয়ে তিন দিন জ্বর নিয়ে মারা যান সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. জারিন তাসনীম রিমি। সর্বশেষ ফেনীর সাবেরা হোসেন গর্ভবতী অবস্থায় করোনা পজিটিভ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জটিল পরিস্থিতিতেও বাঁচানো যায়নি সন্তানকে। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্যে রয়েছেন গর্ভবতী মায়েরা। বিশেষ কিছু কারণে এসব মায়েদের  ৩-৪ বার ডাক্তারের কাছে আসা আবশ্যক। পরিস্থিতির কারণে অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। যার কারণে মা ও গর্ভের সন্তানের অনেক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। শেষ সময়ে যখন তারা হাসপাতালে আসছেন, তখন আইসিইউতে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকছে না। তখন হয়তো বাচ্চাকে বা মাকেও বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া করোনা পজেটিভ থাকলে দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া অপারেশনও করা যাচ্ছে না অন্য সব সরকারি হাসপাতালে। অন্যদিকে এন্তার অভিযোগ রয়েছে গর্ভবতী মা ও স্বজনদেরও। করোনা টেস্ট করে রিপোর্ট পেতে বিলম্ব হওয়ায়ও অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি রয়েছেন আসমা আক্তার (৩২)। অপারেশনের চূড়ান্ত তারিখ পেতে দেয়া হয়েছে করোনা টেস্ট। তিনি জানান, ৪ আগস্ট বুধবার ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রসিদ জমা দেয়া হয়েছে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে নমুনা নিয়ে শুক্রবার বিকালের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা। কিন্তু সেই রিপোর্ট তারা পরদিন শনিবারও দেয়নি। বেলা ২টার মধ্যে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেয়া হলে তিনি বলেছিলেন, অপারেশনের ডেট দেবেন। কিন্তু সেই রিপোর্ট পেতে পরিচালকের রুম থেকে দু-তিনটি স্থানে দৌড়েও পাওয়া যায়নি। এমন আরেকটি অভিযোগ করেন মোহাম্মদপুরের ইসরাত জাহান। তিনি বলেন, সন্তানসম্ভবা পরিস্থিতি নিয়ে অনেক জটিলতায় রয়েছি। মগবাজারের একটি হাসপাতালে সরাসরি ডাক্তার দেখানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি। দু-একবার অনলাইনে দেখানো হলেও এখন সরাসরি দেখানো খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই দেয়া হয়েছে করোনা টেস্ট। এর পেছনে আমাকে টানা এক দিন দৌড়ে রিপোর্ট পেতে তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে- যা আমার জন্য খুব বেশি কষ্টকর হয়েছে।

সন্তানসম্ভবা অবস্থা নিয়ে বেশ কিছুদিন সমস্যায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা নরসিংদীর বুশরা ভূঁইয়া। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন হলেও চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তিনি। তাই বের হচ্ছেন না। তিনি বলেন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব সময়ই শুধু হাসপাতালের দুর্ভোগের কথা শুনছি। সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি নিয়েও ঘাটতি দেখছি। তাই প্রয়োজন থাকলেও বের হতে ভয় পাচ্ছি। অনলাইনেই ডাক্তার থেকে পরামর্শ নিয়ে চলছি।  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, গত বছরের তুলনায় সন্তানসম্ভবা নারীরা কম সেবা নিচ্ছেন। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রসবপূর্ব ন্যূনতম চারবার সেবা নেয়ার হার এক-চতুর্থাংশেরও কম ছিল। এ সময়ে মায়েদের মৃত্যু বেড়েছে ১৭ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯ সালে ৯৬৭ এবং ২০২০ সালে এক হাজার ১৩৩ জন মায়ের প্রসবকালীন মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৮২ জনের। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যুর যত ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এপ্রিলে মারা গেছেন ২২৮ জন। একই সময়ে প্রসবপূর্ব প্রথমবার সেবা নিতে যাওয়া মায়েদের মৃত্যুহার ২৬ শতাংশ কম ছিল। দ্বিতীয়বার ২৫ শতাংশ, তৃতীয়বার ২৬ শতাংশ এবং চতুর্থবার ছিল ২৪ শতাংশ কম।

এদিকে গত এক মাসের একাধিক ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ বয়ে আনছে করোনা ভাইরাস। শেষ চেষ্টা হিসেবে পেটের বাচ্চাকে অ্যাবরশন বা গর্ভপাত করিয়েও মায়েদের বাঁচানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে হঠাৎ করে এমন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়। বাংলাদেশে গর্ভপাত বেআইনি ও অপরাধযোগ্য হলেও শুধু চিকিৎসকের পরামর্শে মায়েদের জীবন বাঁচাতে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সুযোগ রয়েছে। জানা গেছে, চট্টগ্রামে এ কে খান মোড়ের বাসিন্দা জেসমিন আকতারের পেটে যখন ছয় মাসের বাচ্চা, গত ২৪ জুলাই তার নমুনায় করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়। অবস্থা একটু খারাপের দিকে এগোতে থাকলে ৩০ জুলাই তাকে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ৩৫ বছর বয়সী এই গৃহিণীর শারীরিক অবস্থার দ্রুতই অবনতি হতে থাকলে মাত্র একদিন পর ১ আগস্ট তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু সেখানে ক্রমেই তার অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছিল। প্রথম দিন ২০ লিটার গতিতে অক্সিজেন দেয়া হলেও তৃতীয় দিনই তাকে দিতে হলো ৬৫ লিটার গতির অক্সিজেন। চতুর্থ দিন সেটা উঠে যায় ৮০ লিটারে। শেষ চেষ্টা হিসেবে গত ৪ আগস্ট রাতে পেটের বাচ্চা বের করে নেয়া বা অ্যাবরশনের চেষ্টা করলেন ডাক্তাররা। ৫ ঘণ্টার সেই চেষ্টা বিফল হওয়ার পর বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকালে আবার চলে অ্যাবরশনের চেষ্টা। সে দিনটিতে সত্যিকার অর্থেই চলছিল জীবনমৃত্যুর যুদ্ধ। জেসমিন আকতারকে সেদিন দেয়া হচ্ছিল ৯০ লিটার গতির অক্সিজেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ওইদিন রাত ১২টার দিকে মারা যান তিনি।

এছাড়া পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা নিশি (ছদ্মনাম) করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৫ দিন ধরে। অবস্থার অবনতি হলে ৩৮ বছর বয়সী নিশিকে বাঁচাতে তার পেটের ৫ মাসের বাচ্চাকে গর্ভপাত করিয়ে নেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নিশিকে। ৫ আগস্ট সকালে ওই হাসপাতালে আইসিইউ ওয়ার্ডে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান নিশি। হাসপাতাল ও রোগীর নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন ওই রোগীর স্বজন ও হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. অলক নন্দী বলেন, ‘প্রচুর গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। এরা সবাই বয়সে তরুণ। এর বড় কারণ হচ্ছে কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমরা তরুণদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পারিনি। এছাড়াও গর্ভবতীদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন আছে। সেখানেও অনেক ঘাটতি থেকে যায়।’ বারডেম হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এবং অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম  সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানান, বর্তমানে করোনা ভাইরাস এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।  দেশে বছরে গড়ে ২২ লাখ প্রসবের ঘটনা ঘটে। বাড়িতেই এর অর্ধেক করানো হয়ে থাকে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বাকি অর্ধেক বিভিন্ন সেবাকেন্দ্রে করানো হয়। এর ১৫ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং ৮৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়। স্বাস্থ্য  অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন  বলেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গর্ভবতী নারীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের পরিবার থেকেই সুরক্ষিত রাখতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. উম্মে হানি মিতা সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে এক কঠিন সমস্যা পার করছি আমরা। পুরো বিশ্বই বিপদের মধ্যে আছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের গাইনি বিভাগ ‘ওভার লোডেড’। এদের মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ যেমন আছে, নেগেটিভ রোগীও আছে। আমরা যেমনটা জানি, করোনা চিকিৎসায় ডেডিকেটেড অন্যান্য হাসপাতালে সার্জারির অপশন নেই। যেটি ঢাকা মেডিকেল বা মুগদায় রয়েছে। তবে মুগদার চেয়ে ঢাকা মেডিকেলেই চাপটা বেশি। প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ জন ভর্তি হচ্ছেন। তারপরও রয়েছে আইসিইউ সংকট। এসব কাটিয়ে ওঠা সত্যিই বেশ কঠিন।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, করোনাকালে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য স্পষ্ট কিছু গাইডলাইন দেয়া আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের জন্য রয়েছে আলাদা সেবাকেন্দ্র। এখন যদি মায়েরা চিকিৎসা নিতে না আসেন, তাহলে কীভাবে হবে? একজন মা ও তার সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিতে চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞ গাইনি চিকিৎসক ডা. শিখা গাঙ্গুলি গণমাধ্যমকে বলেন, একজন মায়ের গর্ভধারণের পর সন্তান প্রসব পর্যন্ত অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা আছে আট বার। এ চারবার সেবা নেয়ার হার আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে এক-চতুর্থাংশ কম ছিল। সংখ্যা হিসাবে ধরলে এক থেকে আড়াই লাখ হবে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউর অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. সুমন অনিরুদ্ধ বলেন,গত এক মাসে প্রায় অর্ধশত সন্তানসম্ভবা আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।  পেটের অনাগত সন্তানের ভালোর জন্য আমরা সব ওষুধ দিতে পারি না। ৩২ সপ্তাহের গর্ভবতীদের সিজার করে শিশুকে বের করে আইসিইউতে চিকিৎসা দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ২০-২২ সপ্তাহের গর্ভবতীদের চিকিৎসা দিতে অনেক সমস্যা হয়।  সেসব নারীর মৃত্যুহার বেশি; আর সুস্থ হলেও আইসিইউতে থাকতে হচ্ছে বেশি।

আমারসংবাদ/জেআই