Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আদর্শের বাতিঘরের মৃত্যু নেই

আসাদুজ্জামান আজম

আগস্ট ১৪, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


আদর্শের বাতিঘরের মৃত্যু নেই

আজ ১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। শোকাতুর বাঙালি জাতির আত্মদহনের দিন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর একটি শোকের দিন। যে মুজিবের নেতৃত্বে শত বছরের শোষণ আর নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাঙালি, সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালের এই দিনে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শত্রু, মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বিশ্বের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা, বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। কয়েকজন ঘাতকের জন্য সারা বিশ্বে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায় বাঙালি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’ দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ শেখ মুজিবের সুচিন্তা থেকে আজকের বাঙালিরও শেখার আছে উল্লেখ করে ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য  সেন সম্প্রতি বলেছেন, তাকে ‘বাংলাদেশের জনক’ বা বঙ্গবন্ধু বলাটা নিতান্তই কম বলা। তিনি এর চেয়ে বড় কোনো অভিধা এবং নাম কিনতে চাননি। মানুষ তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতো। ঘাতকরা বুঝেছিল শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই তাকে মুছে ফেলা যাবে না, তাই তো ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, জাতির জনকের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন। জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গে উজ্জীবিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করার সব রূপরেখাই তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরাধীনতা থেকে মুক্তির পর রূপকল্প অনুযায়ী বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দানের নেশায় বঙ্গবন্ধু যখন মগ্ন, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার আদর্শ হত্যা করতে পারেনি। আদর্শের বাতিঘর হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন। ঘৃণা আর ইতিহাসের আস্তাকুড়ে পড়েছে ঘাতক ও তাদের পরবর্তী অনুসারীরা। স্বতন্ত্র ভূখণ্ডে স্বাধীন জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয় বাঙালি, আর জাতির পিতা হিসেবে বাঙালি অস্থিমজ্জায় মিশে যান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবাহমান থাকবে। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি। সমগ্র জাতিকে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মোহিতুল ইসলাম বর্ণনানুসারে, ১৯৭৫ সালে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে কর্মরত ছিলেন। ১৪ আগস্ট (১৯৭৫) রাত ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন ওই বাড়িতে। ১৪ আগস্ট রাত ১২টার পর ১৫ আগস্ট রাত ১টায় তিনি তার নির্ধারিত বিছানায় শুতে যান।

মামলার এজাহারে মোহিতুল উল্লেখ করে বলেন, ‘তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আমাকে উঠিয়ে (জাগিয়ে তুলে) বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। তখন সময় ভোর সাড়ে ৪টা কি ৫টা। চারদিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচে নেমে এসে আমার কাছে জানতে চান পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে কেন কেউ ফোন ধরছে না। এ সময় আমি ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বলছি’। এ সময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তাণ্ডবে কাচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এ সময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়েন। আমিও শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ওপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এলো। পাঞ্জাবি ও চশমা পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন, আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কি করো? এ সময় শেখ কামাল বলল, আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়ালো। আমি (মোহিতুল) ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান শেখ কামালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নরুল ইসলাম পেছন দিক থেকে টান দিয়ে আমাকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে গেলো। আমি ওখান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এ সময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। কামাল ভাই চিৎকার করে বললেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই ওদেরকে বলেন।’

মোহিতুল ইসলামের এজাহারের বর্ণনায় বলেন, ‘আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিলো। এ সময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকাণ্ডের জন্যই তারা এসেছে। নূরুল ইসলাম যখন আমাদেরকে রুম থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন মেজর বজলুল হুদা এসে আমার চুল টেনে ধরলো। বজলুল হুদা আমাদেরকে নিচে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করালো। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আর্তচিৎকার, আহাজারি। এরই মধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে মারবে না তো। আমি বললাম, না তোমাকে কিছু বলবে না। আমার ধারণা ছিলো অতটুকু বাচ্চাকে তারা কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, ‘অল আর ফিনিশড’।

অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক রহমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অভিযান পরিচালনা করেন। ওই বাসভবনে অভিযানের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রশিদ দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গভবনে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডালিম ছিলেন বেতার কেন্দ্রে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সামরিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করেছেন তিনি (ফারুক) নিজেই।’

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে রাসেলকে হত্যার এই নৃশংস বর্ণনা দিয়েছেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার গ্রন্থে লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যার পর রাসেল দৌড়ে নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো বাড়ির কাজের লোকজনের কাছে আশ্রয় নেয়। রাসেলের দীর্ঘকাল দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা আবদুর রহমান রমা তখন রাসেলের হাত ধরে রেখেছিলেন। একটু পরেই একজন সৈন্য রাসেলকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর কথা বলে রমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে নেয়। রাসেল তখন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে তাকে না মারার জন্য আল্লাহর দোহাই দেয়।’ রাসেলের এই মর্মস্পর্শী আর্তিতে একজন সৈন্যের মন গলায় সে তাকে বাড়ির গেটে সেন্ট্রিবক্সে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এর প্রায় আধঘণ্টা পর একজন মেজর সেখানে রাসেলকে দেখতে পেয়ে তাকে দোতলায় নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় রিভলবারের গুলিতে হত্যা করে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র দুরন্তপ্রাণ শেখ রাসেল এমন সময়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন যখন তার পিতার রাজনৈতিক জীবনকে দেখতে শুরু করেছিলেন মাত্র। শেখ রাসেলকে হত্যার আগে ঘাতকরা একে একে পরিবারের অন্য সদস্য বড় ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে।

ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। রাজনীতিতেও পুর্নবাসন করা হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব,  লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব, লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তবে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিচার সম্পন্ন হয়। ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এ মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচারকাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে পাঁচ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ২০১০ সালের পর, ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদ এ বছর দেশে ফিরে আসার পর গত ১২ এপ্রিল, ২০২০ তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে পাঁচ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হন খুনি মাজেদ। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছেন। তাদেরকে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরে সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করে দিনটি। তবে এবার বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতপূর্বক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে  বলা হয়েছে, কর্মসূচির  অংশ হিসেবে এ দিন  সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুষ্পস্তবক  অর্পণ, সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক অনার গার্ড প্রদান এবং মোনাজাত করা হবে। ১৯৭৫ সালের  ১৫  আগস্ট তারিখে শাহাদাতবরণকারী জাতির পিতার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য শহীদদের কবরে (ঢাকার বনানীস্থ কবরস্থানে) সকাল সাড়ে ৭টায় পুষ্পস্তবক ও ফুলের পাপড়ি অর্পণ এবং দোয়া ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। এদিন সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের  টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে ফাতেহা পাঠ, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুষ্পস্তবক অর্পণ, সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক অনার গার্ড প্রদান এবং মোনাজাত ও বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। সারা দেশের মসজিদসমূহে বাদ যোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দিবসটির অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। পোস্টার মুদ্রণ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/গ্রোথ সেন্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার সাঁটানো  ও এলইডি বোর্ডের মাধ্যমে প্রচারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।  জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতপূর্বক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল আয়োজন এবং জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

দেশে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতেও জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করছে। জাতীয় শোক দিবসে সকাল সাড়ে ৮টায় ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বেলা ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের শ্রদ্ধা নিবেদন হবে। এ ছাড়া ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশের সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। ১৬ আগস্ট বেলা সাড়ে ৩টায় জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখবেন। করোনা সংক্রমণের উচ্চমাত্রার বিষয়টি মাথায় রেখে এবং ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে ঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আহ্বান জানিয়েছেন।

গৃহীত কর্মসূচি : সকাল ৯টায় ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। সকাল ১০টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মুনাজাত ও মিলাদ মাহফিল। একই সময় টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ও সুবিধামতো সময়ে মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অুষ্ঠিত হবে। দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দলের সকল স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে ই-পোস্টার প্রকাশ : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ইলেকট্রনিক, অনলাইন ও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারের জন্য আজ চারটি বিশেষ ডিজাইনের ই-পোস্টার প্রকাশিত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে এই পোস্টারগুলো প্রকাশ করা হয়। চারটি পৃথক শিরোনামে প্রকাশিত ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা তুমি হূদয়ের বাতিঘর আকাশে বাতাসে বজ্রকণ্ঠ তোমার কণ্ঠস্বর’, ‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো দুলতে থাকে স্বাধীনতা’ এবং ‘এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি পোস্টারগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের আওতাধীন এলাকায় তাদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল ও এলইডি স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হবে। এ ছাড়া করোনা ভাইরাসজনিত বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের অংশ হিসেবে প্রদর্শনযোগ্য প্রচার মাধ্যম যেমন— ইলেকট্রনিক, অনলাইন ও সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে এসব পোস্টার ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই