Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

আশুরার মর্যাদা ও পবিত্র মহররম

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

আগস্ট ১৯, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


আশুরার মর্যাদা ও পবিত্র মহররম

মহররম হিজরি সনের প্রথম মাস। আরবি মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত বা মর্যাদাবান। মহররম একটি সম্মানিত মাস। এ মাসের আছে বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য। আছে আলাদা সম্মান ও মর্যাদা। এটি ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত। জাহেলি যুগেও আরবরা এ মাসকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখত। কুরআনে বর্ণিত চারটি মর্যাদার মাসের মধ্যে একটি অন্যতম মাস। আল কুরআনে এ চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সবরকম পাপাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে: আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে ১২ মাস আল্লাহর কিতাবে, সে দিন (থেকে) যে দিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের ওপর জুলুম করো না, (সূরা তাওবাহ, ৩৬)।

হিজরি সনের সঙ্গে মুসলমানদের বিশেষ ঐতিহ্য নিহিত রয়েছে। যদিও হিজরতের সময়কাল থেকে হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষ গণনা আরম্ভ হয়, কিন্তু এ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে চান্দ্রমাসের গণনা শুরু হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা যে চারটি মাস সম্মানিত বলে ঘোষণা করেছেন, রাসুল (সা.) তাঁর মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণীর মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। রাসূল (সা:) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘সময় ও কাল আবর্তিত হয় নিজ চক্রে। যে দিন থেকে আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এক বছর হয় বারো মাসে। এর মধ্যে চার মাস সম্মানিত। তিন মাস ক্রমান্বয়ে আসে। যেমন- জিলকদ, জিলহজ, মহররম এবং রজব, (বুখারি, ৪৪০৬)।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চন্দ্রমাসের হিসাব মহান আল্লাহর গণনায় রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ চন্দ্রমাসের হিসাব করে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের শরিয়তে ১২ চন্দ্রমাসকে এক বছর গণনা করা হতো এবং তন্মধ্যে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব্তএ পবিত্র চারটি মাসকে বরকতময় ও সম্মানিত মনে করা হতো। এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতো। এ চারটি মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে এর ভয়াবহ পরিণাম ও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি, খুনাখুনি নিষিদ্ধ ছিল।

মহররম মাসে আরবরা কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ করত না। তারা এ মাসে রক্তপাত থেকে বিরত থাকত। নিষিদ্ধ মাস মোট চারটি। এর মধ্যে মহররম অন্যতম। হাদিসে মহররম মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ’ (মুসলিম, ৭৪৭)। ইবনে রজব (রহ.) বলেন, হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, মহররম শ্রেষ্ঠ মাস। কারণ আল্লাহ তায়ালা হারাম (সম্মানিত) মাস দিয়ে বছর শুরু করেছেন এবং হারাম (সম্মানিত) দিয়ে বছর শেষ করেছেন। এর মধ্যে হাদিসে মহররম মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে। আর রমজানের পর মহররম মাস শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ মাস। আবু জর (রা.) বলেন, আমি রাসুলকে (সা.) রাতের শ্রেষ্ঠ অংশ এবং শ্রেষ্ঠ মাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, ‘রাতের শেষ ভাগ শ্রেষ্ঠ এবং মাসের মধ্যে মহররম মাস শ্রেষ্ঠ’ (নাসায়ি, ৪৬১২)।

রাসুলের (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য চন্দ্রমাসের হিজরি সন গণনার সূচনা হয়। আরবি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান সর্বোপরি ইবাদত-বন্দেগির বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। হিজরি সন ইসলামের ইতিহাসের একটি মৌলিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিক এবং মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। হিজরি সন ইসলামের ইতিহাসে একটি মৌলিক ও গৌরবোজ্জ্বল দিক এবং মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। নবী করিম (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মদিনায় হিজরত করেন, কিন্তু এর প্রস্তুতি ও আকাবার শেষ বায়আতের পরবর্তী সময়ে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল, তা ছিল মহররম মাসের। অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হিজরি সনের প্রথম চান্দ্রমাস মহররম থেকে ধরা হয়।

বর্তমান মুসলিম সমাজে শিয়া সমপ্রদায়ের শিরকি ও বিদয়াতি কর্মকা্লের কারণে মহররম ও আশুরা বলতে অনেকেই কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাসকেই বুঝে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মহররম ও আশুরার মর্যাদা, ফজিলত ও আমলসমূহ কারবালার ঘটনারও অনেক আগেই সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও হাদিসে এসেছে। এ দিনে রাসূল (সা:) বিশেষ গুরুত্বের সাথে রোজা রাখতেন। ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা:) মদিনায় (হিজরত করে) এলেন এবং ইহুদিদের আশুরার দিন সিয়াম পালন করতে দেখলেন। এরপর তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলল, এ সে দিন যে দিন আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ:) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের ওপর বিজয়ী করেছেন। তাঁর সম্মানার্থে আমরা সাওম পালন করি। তখন নবী (সা:) বললেন, আমরা তোমাদের চেয়েও মূসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে সাওম পালন করার নির্দেশ দেন’ (মুসলিম, ২৫৪৬)।

রমজানের একমাস রোজা হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। যখন রমজানের রোজাকে ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজার বিধান আর ফরজ থাকেনি, নফল হয়ে যায়। কারবালার ঘটনার আগেই মহররম মাস অতীতে ঘটা দুটি অলৌকিক ঘটনার জন্য সম্মানিত। সহিহ হাদিস মতে, মহররম মাসে আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ:) ও তাঁর সঙ্গীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের থেকে রক্ষা করেন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা নীল নদের পানির মধ্যে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন।

একই রাস্তা পার হওয়ার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদল ডুবে মারা যায়। আর তারপর ফেরাউনের লাশ হাজার বছর ধরে পানির নিচে অক্ষত অবস্থায় থাকে, যা বিশ্বাসীদের জন্য অনেক বড় নিদর্শন। রাসূলের (সা:) ওফাতের পর ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইনের (রা) শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। তাঁকে ইয়াজিদের বাহিনী নির্মমভাবে শহীদ করে। এই ঘটনা অবশ্যই প্রতিটি মুসলিম হূদয়ে রক্তক্ষরণ করে। কিন্তু আমরা সেই শোক ও কষ্টকে প্রকাশ করার জন্য এমন কোনো কাজ করব না- যা আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন।

১০ মহররম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)। মহররমের দশম দিবসে অর্থাৎ আশুরার দিনে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে- আকাশ জমিন পাহাড়-পর্বত সব কিছুর সৃষ্টি, হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি, হযরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ, হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকু্ল থেকে মুক্তিলাভ, দীর্ঘ ১৮ বছর  রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ ইত্যাদি। 

ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিভিন্ন কারণে অশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। প্রাক-ইসলামি যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। অফুরন্ত বরকত ও তাৎপর্যম্লিত মহররম মাসে বহু নবী-রাসুল ঈমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। কারবালাসহ অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। ১০ তারিখ আশুরার সঙ্গে পুরো মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে।

প্রাক-ইসলামি যুগে মক্কার কুরাইশরা আশুরার দিনে রোজা রাখত। নবী করিম (সা.) বাকি জীবনে এদিন রোজা রাখতেন। মদিনায় আগমনের পর রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি আশুরার দিন রোজা রাখতে আদিষ্ট ছিলাম, অতএব এখন তোমাদের কারও যদি ওই দিন রোজা রাখতে ইচ্ছা হয়, তবে তা রাখতে পারো।’ আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসুলের (সা.) আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমান ১০ মহররম আশুরা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে এদিন ঐচ্ছিক রোজা পালন করে। আশুরার দিন নফল রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলকে (সা.) প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এ রোজা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে থাকে’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখবে, আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’ (আহমাদ)।

এ মাসে বেশি বেশি তাওবাহ ও ইস্তিগফার পড়তে বলা হয়েছে। কেননা অতীতে একটি গোত্রের তাওবা এ মাসে কবুল হয়েছিল। এ ছাড়া দরূদ পড়া, কেননা ইস্তিগফার ও দোয়া কবুলের জন্য অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে দরূদ পড়া। এটি যেহেতু সম্মানিত মাস, তাই এ মাসের সম্মানে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকার চেষ্টা করা।

 আশুরায় শিয়া সমপ্রদায়ের মতো শোক প্রকাশের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কোনো বিপদ-আপদের শোককে জিইয়ে রেখে দিনের পর দিন স্মরণ করা ইসলামের রীতিবহির্ভূত। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেন, ‘যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গ্লে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে এবং জাহেলি যুগের মতো চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’ (বুখারি, ১২৯৪)।

তাই আসুন, আল্লাহর দরবারে বিনীত প্রার্থনা করি তিনি যেন মহররম মাসের ইসলামি ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অশেষ সওয়াব হাসিলের তাওফিক দান করেন এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনা স্মরণে প্রতিটি মুসলমানকে ঈমানি চেতনা শক্তিতে বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই