Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

সড়কে মিললো পদ্মার দুই পাড়

আসাদুজ্জামান আজম

আগস্ট ২৩, ২০২১, ০৬:২০ পিএম


সড়কে মিললো পদ্মার দুই পাড়
  • দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে উচ্ছ্বাস
  • মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ
  • ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে

সময়ের সঙ্গে স্বপ্ন বাস্তবায়নের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। সর্বশেষ গতকাল পদ্মা সেতুতে শেষ স্লাব বসানো হয়েছে। এতে সড়কপথে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে পদ্মা সেতু। স্লাবটি বসানোর মাধ্যমে সড়কপথে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট মিলেছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আশার প্রতিফলন ঘটেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। যার কারণে দক্ষিণাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পোস্ট করছেন অনেকেই।

শরীয়তপুর-১ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন অপু লিখেছেন— ‘আলহামদুলিল্লাহ! স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে সর্বশেষ রোডওয়ে স্লাব বসানোর কাজ শেষ হয়েছে!! আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই ১৯৭৫ সাল পরবর্তী বাংলাদেশের সবচাইতে সফল সরকার প্রধান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।’

সূত্র মতে, গতকাল ২৩ আগস্ট সোমবার সকাল ১০টার দিকে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নং পিলারের উপরে শেষ স্লাব বসানো হয়েছে। সেতুর মোট দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের মধ্যে এটি সর্ব শেষ স্লাব। এতে সড়ক পথের ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুর পূর্ণাঙ্গ রূপ ফুটে উঠেছে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, ১০টা ১২ মিনিটের সময় সর্বশেষ স্লাবটি বসানো হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সেতু প্রকল্পের সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৮৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ মূল সেতুর কাজের আর বাকি মাত্র ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি ও আর্থিক অগ্রগতি (ব্যয়) ৯০ দশমিক ১৮ শতাংশ। মূল সেতুর কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত সেতুটির সড়কপথের কাজ প্রায় শেষের পথে। এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করার ক্ষেত্রে বাকি থাকলো শুধু পিচঢালাই। পিচঢালাইয়ের কাজ শুরু হবে আগামী অক্টোবর মাসের শেষ দিকে। এ কাজে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে। সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) সেতু বিভাগকে জানিয়েছে, তারা আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই সব কাজ শেষ করবে। সব মিলিয়ে আগামী মে মাসেই পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া সম্ভব। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি জানিয়েছেন, আগামী অক্টোবর মাসের শেষের দিকে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হবে এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু সমগ্র বাংলাদেশের জন্য এটি এখন মর্যাদার সেতু। সেতুটি নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে। নানা মহলের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অদম্য সাহসিকতায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ১৯৯৮ সালে সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রথমে বিদেশি অর্থায়নে সেতুটির নির্মাণকাজ করার প্রস্তুতি ছিলো সরকারের। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ১৩ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করে। তারা ১৮ মাসের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন, প্রি-কোয়ালিফিকেশন ডকুমেন্ট ও মূল টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রণয়ন ও পরিচালনা করে। ওই সময় পদ্মা সেতুতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। সেতু বিভাগের নিজস্ব প্রকৌশলী এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে অভিজ্ঞ কিছু প্রকৌশলী পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়। সেতুর গুরুত্ব ও ব্যাপকতার কারণে কাজ তদারকি ও পরামর্শের জন্য দেশি-বিদেশি ১১ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এক্সপার্ট প্যানেল। ওই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।

২০০৯ সালেই বিশ্বব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ যায়। দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্বব্যাংক তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেয়া হয় ও সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে জেলেও যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এমন কোনো অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। অভিযোগের কারণে আটকে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে দেয়। তারপরও বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে যেতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন না করার বিষয়ে একেবারেই অনড়। এরপর প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেতু বিভাগ সূত্র মতে, নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনই রেললাইন চালুর টার্গেট নিয়ে চলছে কর্মযজ্ঞ। রেলওয়ে সূত্র মতে, আগামী বছর যখন পদ্মা সেতু চালু হবে একই দিনে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মাওয়া প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালু করার সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সেতুটির দুই পাড়েই রেলওয়ের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, পদ্মা সেতুতে সড়ক ও রেলপথ যুক্ত আছে। রেল অংশটি ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধরা আছে। তবে আগামী বছর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনে মাওয়া প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী দ্রুত কাজ চলমান রয়েছে।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। এর ওপর দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন, নিচ দিয়ে রেল। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির উপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে থাকে পদ্মা সেতু। ৪২টি পিলারের উপর ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান একে একে বসানো হয়। সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। এতে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছিল।

স্থানীয়রা জানায়, প্রতিনিয়তই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে হয়। দুযোর্গপূর্ণ আবহাওয়া দেখা দিলে যাতায়াত ব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কোনো কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকলে রাতের বেলায় রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পদ্মা সেতুর বদৌলতে এ অঞ্চলের মানুষের যাত্রাপথে দীর্ঘদিনের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ লাঘবের পাশাপাশি বাঁচবে সময়। বর্তমানের চেয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সময় অর্ধেক কমে আসবে। আর ট্রেন ব্যবস্থা কার্যকর হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। সরাসরি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হবে।

আমারসংবাদ/জেআই