Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

রোহিঙ্গা সমস্যার চার বছর: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মো. কামসুদ্দীন

আগস্ট ২৭, ২০২১, ০৭:১৫ পিএম


রোহিঙ্গা সমস্যার চার বছর: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ

তিন বছর পার হয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা চার বছরে পড়েছে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর দেশটিতে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ সালের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে জয়ী হয়েছিল। এনএলডি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নির্বাচনি এলাকা থেকেও বহু আসন পেয়েছে। শুধু রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে যারা প্রচারণা চালিয়েছি, তাদের দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) জয়লাভ করেছে। জয়লাভ করে নতুন সরকার কী পদক্ষেপ নেয়— তা দেখার আগেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে পয়লা ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। বর্তমানে দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী।

গত চার বছরে মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দ্রুত থেকে দ্রুততর হোক, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা সে আশায় অপেক্ষা করছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কর্মঅধিবেশনে রোহিঙ্গাসহ সংখ্যালঘু ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের পক্ষে নতুনভাবে ৯টি দেশ ভোট দিয়েছে। আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এ ৯ দেশ রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদের আগেকার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ১৩০ ভোট আর বিপক্ষে ৯ ভোট পড়ে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ ৯ দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুবিষয়ক প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান না নিয়ে ভোটদানে বিরত থেকেছিল। মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও জাপানসহ ২৫টি দেশ প্রস্তাবের ভোটাভুটি থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ১৮ নভেম্বর ২০২০-এ জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি আনে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিসহ আরও কিছু বিষয়ে মিয়ানমারকে পদক্ষেপ নেয়ার কথাও ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণের পর রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জরুরি বৈঠকের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক জানান, এখনো ৬ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে আছে, যাদের মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন শিবিরে অবস্থান করছে।

সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে নিয়ে আসায় মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ বেড়েছে। সর্বশেষ সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ফের কথিত ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালাতে পারে বলে এক বিবৃতিতে গাম্বিয়া তাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং জানিয়েছেন, তার সরকার মিয়ানমারের চলমান বিদেশনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে যে চুক্তি আছে, তাতেও কোনো প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি না করে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা গ্রহণযোগ্য, তাদের ফেরার অনুমোদন দেয়া হবে। ২০২১-এর মার্চে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসিয়ানের মধ্যস্থতা-সংক্রান্ত যে প্রস্তাব তোলা হয়েছিল, সেখানে রাখাইন রাজ্যের নাম না নেয়া হলেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অবস্থানকারীদের সমস্যা (রোহিঙ্গা সমস্যা) সমাধানে আরও মনোযোগী হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সুপারিশে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ‘যাচাই-বাছাইয়ের’ পর প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে বলা হয়েছে এবং আসিয়ান সচিবালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতার পর এর জবাবদিহি নিশ্চিত এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত ভয়াবহ নৃশংসতার পর ১২ জুলাই ২০২১ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রথমবারের মতো কোনো প্রস্তাব ভোটাভুটি ছাড়াই পাস হলো। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় অর্জিত এই সফলতা আমাদের জন্য এক বড় মাইলফল। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশের উদ্যোগে ওআইসি সব সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা, মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি পেশ করা হয়। ওআইসির ওই প্রস্তাবে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এ ছাড়া তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া পর্যন্ত এ গুরুভার বহনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধসহ সব ধরনের নির্যাতন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দায়ীদের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং তদন্ত প্রক্রিয়া জোরদরের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) সেনা প্রশাসনের সঙ্গে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাখাইন প্রদেশে অং সান সু চির এনএলডির তেমন জনপ্রিয়তা নেই। সামরিক জান্তা সরকার ২০২১ সালের ১১ মার্চ থেকে আরাকান আর্মিকে (এএ) সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি হামলা চালানো বন্ধ করে দেশজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে রাজি হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত দুবছরে বিদ্রোহী এ গোষ্ঠীটি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল।

রাখাইনে সামরিক জান্তা যে কোনো আলোচনায় এএনপি এবং এএ’কে সংযুক্ত করতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের আলোচনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে এবং রোহিঙ্গা সংকট এত সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশকে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ চলমান রাখার পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে আরও সক্রিয় হতে হবে। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো অং সান সু চির দল এনএলডিসহ দেশটির বিরোধী দলগুলো গত ১৬ এপ্রিল একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ে তুলেছে, যা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি নামে পরিচিত। এনইউজি রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৩ জুন এনইউজি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেশ কয়েকটি অঙ্গীকার করা হয়েছে। এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা যে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতির পাশাপাশি যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। এ ঘোষণায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার আছে। সে সঙ্গে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বিলোপের অঙ্গীকার করেছে। এ আইন দ্বারা রোহিঙ্গাদের অধিকার হরণ করা হয়েছিল।

২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের রাজনীতিকদের এতটা খোলাখুলি রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি। এটি মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের তরফ থেকে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি।

মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে জানিয়েছে। তাদের সদিচ্ছাকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। তবে তারা কীভাবে তা করবে এবং আদৌ তারা আরাকানের আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থন পাবে কি না— এসব বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়নের মতো অবস্থা তাদের এখনও আসেনি। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের ওপর চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ থেকে এ পর্যন্ত আট ধাপে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। সম্প্র্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বাকি ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে সরিয়ে নেয়ার আগেই ভাসানচরের কাজে যুক্ত হবে জাতিসংঘ। অন্যান্য দাতা সংস্থার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশকে সহায়তায় বিশ্বব্যাংক কাজ করছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য যে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি আছে, তা রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত পাঁচটি চলমান প্রকল্পে ব্যয় হবে।

কী হয়নি : আন্তর্জাতিক সংস্থা, আসিয়ান দেশগুলোসহ আঞ্চলিক দেশগুলো আরাকানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মতো মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনো সেক্টরে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে আরাকানের অধিবাসীদের জীবনমান ও আর্থসামাজিক অবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। আরাকানে চলমান সামরিক অভিযান এখনও কার্যত বন্ধ হয়নি এবং আরাকানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের উপযোগী হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সব মিলিয়ে চার বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রত্যাবাসন এখনও আলোর মুখ দেখছে না।

কী হতে পারে : বর্তমানে মিয়ানমারের ছায়া সরকার, এনইউজি সামরিক শাসনবিরোধী দল ও ব্যক্তিদের একত্র করে একটি ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অবশ্য তাদের এ উদ্যোগ এখনো আন্তর্জাতিক সাড়া পায়নি। এ কায়দায় তাতমাদার মতো অভিজ্ঞ বাহিনীকে মোকাবিলা করা কঠিন। কিন্তু এ পরিস্থিতি মিয়ানমারকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে; যার পরিণাম শুধু মিয়ানমার নয়— পুরো অঞ্চলকে ভোগ করতে হবে।

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রভাব ফেলবে। এতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে এই ১১ লাখ রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার বদলে নতুন শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যান্য শরণার্থীও যুক্ত হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে নিজেদের আবাসস্থলে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দৃশ্যমান ও কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান চলমান রাখতে হবে।

কী করা যেতে পারে : বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলমান এ সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা চলমান রাখতে রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে প্রতি বছর ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ বানিয়ে বিভিন্ন ভাষায় তা প্রচার করা যেতে পারে।

দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন— ইউএনএইচসিআর, আইওএম, ডব্লিউএইচও, নিরাপত্তা পরিষদ ও পরিবেশ-সংক্রান্ত সম্মেলনগুলোয় রোহিঙ্গা সমস্যার নানা দিক নিয়ে যেমন নিরাপত্তা, পরিবেশ, মা ও শিশুস্বাস্থ্য, নারীর অধিকার, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন-সংক্রান্ত আলোচনায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্ববাসীর কাছে নিয়মিতভাবে তুলে ধরা।

মিয়ানমারে টেলিভিশনের ব্যবহার সীমিত, প্রকাশনা-মাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকায় রেডিওই যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। কাজেই এ মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণের সাথে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব। এ মাধ্যম ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায় ও রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে।

মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় রূপ নিতে পারে। এ সময়কালে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য খাদ্য, অর্থ ও মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখার বিষয়ে জাতিসংঘ এবং দাতা সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দান করেন। চলমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত চার বছরে মিয়ানমারের অসহযোগিতা আর অনীহার কারণে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দ্রুত হোক, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা সে আশায় অপেক্ষা করছে।

লেখক : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক লেখক ও গবেষক

এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি (এলপিআর)

আমারসংবাদ/জেআই