Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে সফল বাংলাদেশ

মাহমুদুল হাসান

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


মা ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে সফল বাংলাদেশ
  • ৫০ বছরে শিশু মৃত্যুহার
  • ৮৫ ভাগ কমেছে
  • লক্ষ্য মাতৃমৃত্যু ৫০-এর নিচে নামিয়ে আনা
  • সাফল্যের জন্য এমডিজি অ্যাওয়ার্ড অর্জন
  • প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

৫০ বছরে মা ও শিশু মৃত্যুহার কমেছে। মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ধারাবাহিক সাফল্যে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। ২০১৯ সালের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, ২০০৪ সালে প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে মাতৃ মৃত্যুহার ছিলো ৩ দশমিক ২০ শতাংশ। বর্তমানে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশে।

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মা ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর কৌশলপত্রের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে প্রতি লাখ সন্তান প্রসবে মাতৃ মৃত্যুহার ছিলো ২৫৯ জন। সম্প্রতি সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে। গত ১০ বছরে মাতৃ মৃত্যুহার কমেছে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে প্রায় ৯৪ জন।

এদিকে শিশু মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। স্বাধীনতার সময় শিশু মৃত্যুহার ছিলো এক হাজার জনের মধ্যে ১৪১ জন। এখন তা ২১। অর্থাৎ শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ অর্জন করেছে।

গত ৫০ বছরে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে বাংলাদেশের অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। শূন্য থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে     বাংলাদেশের সাফল্যকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্বীকৃতি দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ৫০ জনের নিচে নামিয়ে আনা।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ১৯৭২ সালে এক হাজার শিশু জন্ম নেয়ার পর ১৪১টি শিশু মারা যেতো বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। আর এখন মারা যায় ২১টি শিশু। পাকিস্তানে এখন শিশু মৃত্যুর হার ৫৫। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছরে পাকিস্তানে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিলো। সংখ্যাটি ছিলো ১৩৯। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে দেশের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য মিলেছে।

এক্ষেত্রে মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসেও পিছিয়ে নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভূমিকা রয়েছে দেশের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি, জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পরামর্শ প্রদান।

এছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নারী শিক্ষার প্রসার, নিরাপদ মাতৃত্ব গ্রহণ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও টেলিমেডিসিন সেবার প্রদান, প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান, সন্তান প্রসব পরবর্তী সেবা প্রদান, সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ডায়রিয়াজনিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, পুষ্টি কর্মসূচি শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। কৃমিনাশক, ভিটামিন ‘এ’ কর্মসূচি শিশুদের অবস্থার উন্নতি করেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই মাতৃস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিশুপুষ্টি এসব বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিয়েছিল। দেশের সংবিধানে, বিভিন্ন সময়ে নেয়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যনীতি এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচিতে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়।

গত ৫০ বছরে ধারাবাহিকভাবে এসব কাজ হয়ে এসেছে। তার ধারাবাহিকতায় এখনো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তত্ত্বাবধায়নে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানুর নেতৃত্বে একদল দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে মা ও নবজাতকের সব সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি ঘটছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বার্ষিক গ্লোবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে গত দুই দশকে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে ভুটানের শিশু মৃত্যুহার কমেছে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতের ৫৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে ৬৩ শতাংশ।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ২৪ বছরে দেশে শিশু মৃত্যুহার ৭৩ শতাংশ কমেছে। এসডিজি অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য থেকে এক মাস বয়সি শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ২৮ জন। তবে, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৮ জন। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০৩৫ সালের মধ্যে জীবিত জন্মানো শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শিশুপুষ্টির সূচকে দেশ উন্নতি করেছে।

শিশু যদি ধারাবাহিকভাবে অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তার উচ্চতা বয়সের তুলনায় কমে যায়, শিশু খর্বাকৃতির হয়। খর্বকায় শিশুর হার দেশে ক্রমাগত কমছে। বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর হারও কমেছে। ২০০৭ সালে ছিলো ৪১ শতাংশ। আর এখন তা ২২ শতাংশ। অন্যদিকে হঠাৎ তীব্র অপুষ্টির শিকার হওয়া শিশুর হারও আগের চেয়ে কমেছে। এসব শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম থাকে। এই প্রথম এই হার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। দেশে পাঁচ বছরের কম কৃশকায় (ওয়াসটিং) শিশুর হার ৮ শতাংশ। ২০১৪ ও ২০০৭ সালে তা ছিলো যথাক্রমে ১৪ ও ১৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুরোধে সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। আর এই কারণেই দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু উভয়ই কমেছে। ২০১৭ সালে গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ জন থাকলেও বর্তমানে তা ১৭২ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুহার ২০ জন থাকলেও বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১৮ দশমিক ৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে প্রিম্যাচুউরড এ শিশু মৃত্যুহারের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দেয়া আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবাই সঠিকভাবে সঠিক কাজটি করলে এই অপরিণত শিশু মৃত্যুহারের লক্ষ্যমাত্রা আগামী দুই বছরেই অর্জন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে দেশের সব সরকারি হাসপাতালেই গর্ভবতী মায়েদের জন্য ২৪ ঘণ্টা ডেলিভারি সুবিধাও রাখা হবে।