Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

পরিবেশ রক্ষায় শত বছরের কৌশল প্রণয়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


পরিবেশ রক্ষায় শত বছরের কৌশল প্রণয়ন

পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশকে বছরে দুই বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত ধনী দেশগুলো দায়ী। আর জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে বিশ্ব।

যার কারণে বিপর্যয় কাটিয়ে পৃথিবীতে মানববসতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা, সবুজায়ন এবং পরিবেশগত মানোন্নয়ন করে আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে কাজ করছে সরকার।

২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ ভূমি বৃক্ষাচ্ছাদিত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য প্রভাব নিরসনে ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ নামে ১০০ বছরের কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের কঠোর নির্দেশনায় প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। করোনা সংকটে পুরো খাতকে স্বাভাবিক রাখতে কঠোর পরিশ্রম করছেন তিনি। তার নানা উদ্যোগ এবং কঠোর নির্দেশনায় করোনার প্রথম সংকটকালীন সময়ে এবং চলমান সংকটেও ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

তার নেতৃত্বে প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, বনজ সম্পদ উন্নয়ন ও সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর বাস উপযোগী টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণে সারা দেশে নানা উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৯ (বিসিসিএসএপি, ২০০৯) চূড়ান্ত করা হয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম এই ধরনের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা ২০০৯ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের রাজস্ব বাজেট থেকে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু সহিষ্ণু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করাই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট আইন-২০১০ পাস করা হয়।

জাতিসংঘের তথ্য মতে, পরিবেশ বিপর্যয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। ২০৭০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তিনটির মধ্যে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত ৫০ বছরে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী হ্রাস পেয়েছে। সে হিসাবে গত ১০ মিলিয়ন বছরের তুলনায় বর্তমানে প্রজাতি বিলুপ্তির গড় হার ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি।

পৃথিবীব্যাপী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভগুলো মনুষ্য কর্মকাণ্ডে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগে মানুষ ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সামুদ্রিক প্রতিবেশ পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৩২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয় রোধ এবং পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, মুজিববর্ষের কর্মসূচিসহ গত এক বছরে বন বিভাগের মাধ্যমে দেশে মোট আট কোটি ৬১ লাখ ৬২ হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। এক কোটি চারা রোপণের পাশাপাশি চলতি বছরে বন অধিদপ্তর কর্তৃক বিভিন্ন প্রকল্প ও রাজস্ব বাজেটের আওতায় ১৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর ব্লক বাগান, এক হাজার ৬১০ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান এবং উপকূলীয় এলাকায় ১০ হাজার ৭৭ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজনের মাধ্যমে সাত কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে।

এছাড়াও জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে সংসদ সদস্যগণের মাধ্যমে মোট ১৪ লাখ ৮০ হাজারটি বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষের চারা সারা দেশে রোপণের জন্য বিতরণ করা হয়েছে। বৃক্ষ জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, কার্বন নিঃসরণ প্রশমণ, অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য-পুষ্টিসহ দেশের বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধিসহ দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ রক্ষায় সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। সকল অবৈধ ইটাভাটার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ইট পোড়ানো নিরুৎসাহিত করতে সকল সরকারি কাজে ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লক ইট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে। অবৈধভাবে দখলকৃত সরকারি বনভূমি পুনরুদ্ধার, পাহাড় ও টিলা কর্তন রোধ, অবৈধ ইটভাটা এবং নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা জোরদারকরণ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিষিদ্ধ ঘোষিত অবৈধ পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যাগের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, উপকূলীয় এলাকায় এক বছরের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ এবং একই সময়ে সারা দেশের হোটেল, রেস্টুরেন্টে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেইঞ্জ স্ট্রাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্লান’ হালনাগাদ করে, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেইঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছে, ‘ন্যাশনাল এডাপটেশন প্লান ইমপ্লিমেন্টেশন রোড ম্যাপ’ তৈরি করেছে। পরিকল্পনা মোতাবেক ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেইঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’-এর অর্থায়নে দেশে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

উপকূলজুড়ে চার হাজার ২৯১ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া, দেশের বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অতিরিক্ত ৫২৩টি বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে পশুপাখির আশ্রয় প্রদানের জন্য ৫৫০ ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মিত হয়েছে।

বর্তমান সরকার বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ওজোন স্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস পালন করা হয়।

১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোন স্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এই দিনের স্মরণে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা। ওজোন স্তর রক্ষায় ১৯৮৫ সালের ২২ মার্চ গৃহীত ভিয়েনা কনভেনশন ও ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গৃহীত মন্ট্রিল প্রটোকল অনেক সাফল্যে গাঁথা।

১৯৯০ সালে এ দুটিতে স্বাক্ষরের পর গৃহীত কার্যক্রমের কারণে বিশ্ববাসীর সঙ্গে বাংলাদেশও এই সাফল্যের অংশীদার। প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশে অন্যতম ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য সিএফসি, হ্যালন, কার্বনটেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফরম ও মিথাইল ব্রোমাইডের ব্যবহার বিগত ১ জানুয়ারি ২০১০ সালে রোধ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে ওষুধশিল্পে ব্যবহূত অবিশিষ্ট সিএফসির ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, ১৯৯২ সালে প্রথম পরিবেশ নীতি, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০১০ সালে পরিবেশ আদালত আইন বলবৎ করে। জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে লাল শ্রেণিভুক্ত সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ ও পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার দেশের ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হওয়ার সম্ভাব্য সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬-এর নিষিদ্ধ কার্যক্রসমূহ দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ‘প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় সমাজভিত্তিক অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। টাঙুয়ার হাওরের প্রতিবেশ সুরক্ষায় আগে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সমুদ্র প্রতিবেশ সংরক্ষণ, সমুদ্রদূষণ রোধ, সমুদ্র সম্পদ আহরণে ও সমুদ্র সম্পদের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্লু-ইকোনমি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, দেশকে ‘ক্লিন ও গ্রিন’ করার লক্ষ্যপূরণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করছি।