Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

এন্টিভেনম বৃদ্ধিতে কমেছে মৃত্যু

মাহমুদুল হাসান

সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


 এন্টিভেনম বৃদ্ধিতে কমেছে মৃত্যু
  • স্থানীয় পর্যায়ে এন্টিভেনম তৈরিতে জোর দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
  • দেশীয় এন্টিভেনম তৈরিতে চলছে পাঁচ বছরের পাইলট প্রকল্প

বর্ষা মৌসুমে গ্রাম ও চরাঞ্চলে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। নিজেদের আবাসস্থল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের বসতিতে আশ্রয় খোঁজে  তারা। আবার বানের পানিতে প্রতিবেশী ভারত থেকেও বিরল ও বিষধর সাপ ভেসে আসে। গত ১০০ বছর পর দুর্লভ বিষধর রাসেলস ভাইপার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। রাজশাহী অঞ্চল ও পদ্মার চরে এখন রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক।

সম্প্রতি শরীয়তপুরে এক নৌ-শ্রমিককে রাসেলস ভাইপার ছোবল দেয়। এটি শ্রীলঙ্কার কিছু অঞ্চল, ভারতের কিছু অংশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় ১০০ বছরেও এ সাপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি।

 ২০১৩ সালে প্রথম রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা রাসেলস ভাইপারের ছোবল দেয়া রোগী পান। পাঁচ বছরে ৩০০ রোগী পেয়েছেন তারা। গত কয়েক বছরে কুষ্টিয়াতেও এ সাপের বিচরণ সম্পর্কে জানা গেছে। মাতৃমৃত্যুর চেয়ে দেশে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুহার বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে সাপে কাটে। মারা যায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ। ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে নদী ও সাগরের সব সাপই বিষধর। তবে গোখরার তিন প্রজাতি ও কেউটের কয়েক প্রজাতিতে প্রাণহানি বেশি।

এসব সাপের ছোবলে প্যারালাইসিস হয়; হাত-পা, চোখ, চোয়াল নাড়তে পারে না; ঢোকও গিলতে পারে না রোগী। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব অকেজো হয়ে মারা যায়। কেউ কেউ পঙ্গুও হয়ে যায়। রাসেলস ভাইপার গোখরা-কেউটের চেয়েও বিষধর। এই সাপেকাটা রোগীরা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও প্রতি তিনজনে একজন মারা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনমতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের ছোবলের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ২৫-২৭ লাখ মানুষের শরীরে বিষ প্রবেশে প্রায় দেড় লাখের মৃত্যু ও প্রায় পাঁচ লাখ অন্ধ বা চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।  আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাপে কাটার ঘটনা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। গবেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে বেশি কাটে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় সাপে বেশি কাটে। শীতকালে গোখরা সাপে কাটার ঘটনা ঘটে। বর্ষাকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাপেকাটা রোগী হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু ঘটে।

চলতি বছর সারা দেশে এন্টিভেনমের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় মৃত্যুহার কমেছে। প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে বিষাক্ত সাপে কেটে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। ফরাসি চিকিৎসক আলবার্ট কেলমেট কর্তৃক ১৮৯৫ সালে এন্টিভেনম আবিষ্কার সাপেকাটা লাখ লাখ রোগীকে নতুন জীবনের দিশা দিয়েছে। তবুও সমাজে কুসংস্কার থাকায় সাপেকাটা রোগী নিয়ে হাসপাতালে না এসে স্বজনরা ওঝার কাছে যান। এতে মৃত্যুহার বেড়ে যায়।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সাপেকাটা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। দেশের প্রান্তিক জনপদে এই বার্তা পৌঁছাতে হবে যে, সাপে কাটলে ওঝা নয়— চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এতে বিলম্ব করলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। আগামী বছরের (২০২২ সাল) মধ্যে দেশে এন্টিভেনম তৈরির আশাবাদ ব্যক্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসায় প্রতি বছর সরকার প্রায় ১০০ মিলিয়ন টাকার এন্টিভেনম ক্রয় করে। এসব এন্টিভেনম আসে ভারত থেকে। ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, বাংলাদেশে সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ সাপের সাথে মেলে। সাপের ছোবলে রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে এন্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি একেক রকম। বাংলাদেশ স্থানীয় সাপ থেকে এন্টিভেনম তৈরির পাঁচ বছরমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের মধ্যে ২৬ প্রজাতি বিষধর। বাকি ৬৮ প্রজাতির সাপে বিষ নেই। এরা ছোবল দিলে তেমন কিছুই হয় না। বিষধর ১২ প্রজাতির সাপের অবস্থান সাগরে। বাকিগুলো গহীন জঙ্গল ও লোকালয়ে বসবাস করে। দেশে সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন টাকার এন্টিভেনম আমদানি করতে হয়। আট কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশে সরকারি উদ্যোগে প্রথমবারের মতো এন্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় পাঁচ বছরমেয়াদি এন্টিভেনম তৈরির প্রকল্পটিতে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। জার্মানি থেকে জীববিজ্ঞানীরা এসে নিজেকে নিরাপদ রেখে বিষধর সাপ ধরা ও সাপগুলোকে খাইয়ে সুস্থ অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে মনোসেলেট কোবরা, বিনোসেলেট কোবরা, বানডেড ক্রাইট, ডব্লিউএলপি ভাইপার, এসটিপি ভাইপার, রাসেলস ভাইপার, জি ব্ল্যাক ক্রাইট, কমন ক্রাইট, লাল গলার কিলব্ল্যাক ৯ প্রজাতির ১২০টি সাপ পোষা হচ্ছে। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্প শেষ হবে ২০২২ সালে। এটি সম্ভব হলে এন্টিভেনমের দাম অর্ধেকে নেমে আসবে।

এর আগেও বাংলাদেশে এন্টিভেনম তৈরির একটি প্রকল্পে গবেষক ছিলেন ড. ফরিদ আহসান। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এন্টিভেনম তৈরির একটি প্রকল্পে কাজ করেছি। ভেনম সংগ্রহের পর সেগুলো আমরা তাইওয়ানে পাঠাই। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর প্রকল্পটি আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি।