Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আস্থার শেষ পেরেকে ইসি

সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


আস্থার শেষ পেরেকে ইসি
  • নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু না হওয়ায় আওয়ামী লীগের দুঃখ প্রকাশ
  • সরকার ও নির্বাচন কমিশনে মানুষের আস্থা নেই —বলছে বিএনপি
  • ইসি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে —দাবি আসকের
  • ভোট এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে :বদিউল আলম মজুমদার (সুজন সম্পাদক)
  • ভোট ছাড়াই ৪৩ প্রার্থীর জয়ে নির্বাচন ম্লান হয়েছে: মাহবুব তালুকদার (নির্বাচন কমিশনার)

নির্বাচন! সংঘর্ষ-বোমাবাজি, আহত, খুন। এবার স্থানীয় সরকার পর্যায়ের ভোটেও। আগ্রহ হারিয়েছে মানুষ। নেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিনা ভোটেই বড় সংখ্যক নির্বাচিত। স্বয়ং কমিশনের পক্ষ থেকেই নির্বাচন ‘অম্লান’ বলে বলা হচ্ছে। নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ ক্ষমতাসীন দলের।

পর্যবেক্ষণ সংস্থাও বলছে, চলমান নির্বাচনগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা করা হচ্ছে না। বিএনপির দাবি, দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণের ভোটে মানুষের আস্থা নেই। বিএনপির ভোট বর্জনের সঙ্গে দেশের মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করছেন।

সুশীলসমাজ মনে করছে, ভোট এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। মানুষ জেনে গেছে, ভোট দেয়া এবং না দেয়া একই কথা। সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থার সক্ষমতা নেই নির্বাচন কমিশনের, তা স্বয়ং সংস্থাটির পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে খবর আসছে। আস্থার শেষ পেরেকে দাঁড়িয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী নির্বাচনগুলোতে যদি আস্থা না ফেরাতে পারে তাহলে মানুষ স্থায়ীভাবে নির্বাচন বিমুখ হয়ে যেতে পারে।

সমপ্রতি দেশে ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ৯টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। ৪৩টি ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। বাকি ১১৭টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে। এ নির্বাচনে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট হওয়ায় আট ইউপিতে ৬৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ব্যালটে ভোট হওয়া ১০৯টিতে ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে হওয়া এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ইউপি নির্বাচন বিএনপি বর্জন করার পরও সহিংসতায় দুইজন নিহত হয়েছে। ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল আর ব্যালট উধাওয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয় ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ। বিএনপি নেই, দলীয় ভোটের নির্বাচনও রক্ত ছাড়া সমাপ্ত হয়নি। ক্ষোভ নির্বাচনে চোখ রাখা সংস্থাগুলোরও।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক বলছে, নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল পক্ষের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অপরিহার্য।

এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে চলমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব না। গতকাল বুধবার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মাহবুব তালুকদার এ কথা বলেন।

এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনে বহুদলের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের কারণ বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য। ভোটারদের নির্বাচন বিমুখতাও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

তিনি বলেন, এই সব কিছুর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা জড়িত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটের টার্ন আউট মোটামুটি ভালো ছিলো, শতকরা ৬৯.৩৪ ভাগ। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদে ৪৩ জন প্রার্থী নির্বাচন না করেই চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হওয়ায় এই নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। অন্যদিকে ৯টি পৌরসভায় তিনজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন যেহেতু অনেকের মধ্যে বাছাই, সেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচিত হওয়া বলা যায় কি?’

মাহবুব তালুকদার বলেন, “গত ১৫ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে’ মিডিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবার নীরবতা আমাকে হতাশ করেছে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা কি গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় শামিল হতে অনীহা প্রকাশ করছি?”

তিনি বলেন, ‘গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়দিনের জন্য আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করি। কয়েকজন সাংবাদিক ওই সময়ে অনুষ্ঠিত ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও ৯টি পৌরসভা নির্বাচনে আমার সাফল্য ও ব্যর্থতা জানতে চান। এহেন সংক্ষিপ্ত সময়ে আকস্মিকভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। নির্বাচনে তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি সর্বদা বলে এসেছি জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়। তবু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ে সহিংসতা রোধ করা গেল না। নির্বাচনে ঘটনা বা দুর্ঘটনা যা-ই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের ওপরই দায় এসে পড়ে।

তবে নির্বাচনের সকল দুর্ঘটনা, অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, অবৈধভাবে ব্যালটে সিল মারা, প্রতিপক্ষকে হুমকি প্রদান ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি।

তিনি বলেন, সোমবার অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন এবং পৌরসভা নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি দুঃখজনক ঘটনা, বিশেষ করে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। এ কথা সত্য যে, গতকালের নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বেড়েছে, দেখা গেছে স্বতঃস্ফূর্ততা। আমরা আশা করি নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কার্যকর এবং কঠোর পদক্ষেপ নেবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আইন, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা সব কিছু। ফলে মানুষের আর আস্থা ও আগ্রহ নেই নির্বাচনে। তাই আমরা নির্বাচনে থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী? এর ফল তো এখন দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন দলীয়ভাবে করে সব শেষ করে দিয়েছে। আমরা এই নির্বাচনে না থাকার পরও তারা বলছে আমাদের লোকজন প্রার্থী হয়েছে। এর মানে হলো তারা এখন চাইছে তাদের অপকর্মের সাথে অন্যরাও শরিক হোক। এই শরিক যখন হচ্ছে না তখন তাদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম বলেন, আস্থার শেষ পেরেকে দাঁড়িয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী নির্বাচনগুলোতে যদি আস্থা না ফেরাতে পারে তাহলে মানুষ স্থায়ীভাবে নির্বাচনবিমুখ হয়ে যেতে পারে। ভোটারদের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তিনিই জয়ী হবেন। ফলে ভোট দিতে যাওয়া না যাওয়াতে কিছু আসে যায় না। ভোট এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।

তবে নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র সাংবিধানিক পথ। এটি রুদ্ধ হয়ে গেলে অশান্তিপূর্ণ ও অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা বদলের সুযোগ তৈরি হয়, এটি কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। আমরা আশা করবো নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্বে ফিরে আসবে।