Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

স্বাস্থ্য খাতে সফল রাষ্ট্রনায়ক

মাহমুদুল হাসান

সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


স্বাস্থ্য খাতে সফল রাষ্ট্রনায়ক
  • কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল
  • চিকিৎসাসেবার বেড়েছে পরিধি
  • স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব
  • মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিলো না
  • প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় সফল কমিউনিটি ক্লিনিক
  • ঘটেছে ওষুধ শিল্পের বিকাশ
  • নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর গঠন

স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের বেশির ভাগই ঘটেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। পিতার রেখে যাওয়া সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চার মেয়াদের শাসনামলে স্বাস্থ্য খাতে ঈর্ষণীয় কাজ করেছেন। বাড়িয়েছেন স্বাস্থ্যসেবার পরিধি। বলা হয়, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষা বিস্তারের অধিকাংশ অর্জন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেন। এখন আরও চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তিনিই স্থাপনের কৃতিত্ব অর্জন করেন।

বিশেষায়িত হাসপাতাল, উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট কিংবা প্রান্তিক হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি সবকিছুই তিনি বাড়িয়েছেন। এক যুগের বেশি সময়ের শাসনামলে সরকারি হাসপাতালে তিনি সাত হাজারেরও বেশি শয্যা বৃদ্ধি করেছেন। ২০০৯-এ গণমুখী স্বাস্থ্যনীতির ধারায় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে স্বাস্থ্যকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার যে প্রচেষ্টা শুরু, তা গত এক দশকে শতধারায় বিকশিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়; বিশ্বে তা এক মডেল, অনুশ্রেয় মানদণ্ড। দেশের জন্য ঈর্ষণীয় এবং তা জাতির ভবিষ্যৎ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নির্ধারিত সময়ের আগে এমডিজি অর্জন।

এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা সবকিছুই বাঙালি জাতিকে গর্বিত করে। বর্তমান সরকারের সুদক্ষ পরিচালনায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে, যার মূলে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অর্জনগুলো। এ সরকারের আমলেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ নামে দুটি নতুন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও মাঠপর্যায়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রাথমিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বিগত এক দশকে।

মাঠপর্যায়ে ১২ হাজারের বেশি নারীকে স্কিলড বার্থড এটেনডেন্ট হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে; মিডওয়াইফ সেবা জোরদার করতে তিন হাজারের বেশি মিড ওয়াইফ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০০৭ সালে দেশে নারীপ্রতি গড় সন্তান গ্রহণের হার ২.৭ ছিলো, যা বর্তমানে ২.২-এ নেমে এসেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারী দম্পতি ২০০৭ সালের ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় চার বছর আগে ২০১০ সালে সরকার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ এর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এমডিজি অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত করেছে, যা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প বর্তমান সরকারের আমলে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত এসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়। আগের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সংস্কার ও নতুন আরও ক্লিনিক তৈরি করায় বর্তমানে ১৩ হাজার ৮৮২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সারা দেশের গ্রামপর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় মোট ৭৫ কোটি ৭০ লাখ সেবাগ্রহীতা সেবা গ্রহণ করেছেন। এক জরিপে ক্লিনিকসমূহে সেবা গ্রহীতাদের ৮৫ ভাগ প্রাপ্ত সেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অতিমারি করোনা মোকাবিলায় তিনি রেখেছেন অসামান্য ও অনন্য অবদান। ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি প্রতিবেশী ভারত যেখানে করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের তত্ত্বাবধানে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হওয়ায় দেশ এখন কোভিডের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত। এসব সম্ভব হয়েছে দূরদর্শী চিন্তা, কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ, দক্ষ নেতৃত্বে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ, ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ৫ শতাংশের নিচে এখন করোনা শনাক্তের হার। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব স্বীকৃতির কথা। আজ মঙ্গলবার সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন। দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপন করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৭৫ লাখ ডোজ করোনার টিকাদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জন্মদিনে আমার সংবাদের বিশেষ আয়োজন স্বাস্থ্য খাতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, অবদান ও সাফল্য তুলে ধরা হলো—

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল : অতিমারি করোনায় যখন গোটা বিশ্ব লণ্ডভণ্ড তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফল। একটি আরটিপিসিআর ল্যাব থেকে এখন ৮২০টি ল্যাবে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা চলছে। অল্পদিনেই গড়ে উঠেছে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল। ফিল্ড হাসপাতাল। কোভিডের সঙ্গে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও থেমে থাকেনি। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার পরিধিও বেড়েছে অভাবনীয় গতিতে। ফলে সাড়ে ১৫ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হলেও মৃত্যু হয়েছে মাত্র সাড়ে ২৭ হাজারের কম। শনাক্তের হার এখন চার শতাংশের ঘরে। এসব অবদানের রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ব্লুমবার্গে প্রকাশিত জরিপে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৫৯ দশমিক ২ স্কোর নিয়ে শীর্ষে (তালিকার ২০তম অবস্থানে) আছে বাংলাদেশ। এমনকি জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোও রয়েছে এই তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে। সম্প্রতি দ্রুতগতিতে চলছে টিকাদান। স্বাস্থ্য অদিদপ্তরের তথ্যমতে, দুই কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪৬ জন ব্যক্তিকে প্রথম ডোজ ও এক কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার ৪৬০ জনকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে সারা দেশে এক যোগে ৭৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্মা, মডার্না ভ্যাকসিনসহ ক্রয়কৃত ও কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিজের আওতায় মোট ভ্যাকসিন দেশে এসেছে চার কোটি ৯৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৪০ ডোজ। গতকাল আরও ২৫ লাখ ডোজ টিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে। এ ছাড়াও চীনের সিনোফার্মার ছয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয়ের চুক্তি অনুযায়ী এ মাস থেকেই প্রতি মাসে দুই কোটি ডোজ করে ভ্যাকসিন দেশে আসার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে আরও সাড়ে ১০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনসহ মোট ২৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ক্রয়ের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।

চিকিৎসাসেবার বেড়েছে পরিধি : বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় সাত হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন বিশেষায়িত ও জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা শিশু হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিশু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণের আইন পাস হয়েছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ডিজিসেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় ইনস্টিটিউট অব ইএনটি, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ মোট ১৩টি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। ২০টি হাসপাতাল সমপ্রসারণ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সব জেলা হাসপাতালকে তিনি ২৫০ শয্যা, যেগুলো ২৫০ শয্যার ছিলো সেগুলোকে ৫০০ শয্যা এবং ৫০০ শয্যার হাসপাতালকে এক হাজার শয্যায় রূপান্তরিত করেছেন। নতুন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৩৬টি। দেশে এই প্রথম জেলা হাসপাতালগুলোতে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালগুলোকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করেছিলেন। ফলে বিশেষত গরিব মানুষ উন্নত সেবা পেতে থাকে।

স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির নীরব বিপ্লব : বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন হিসেবে স্বাস্থ্য খাতেও ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক তথ্য জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্যভাণ্ডারে জমা করছেন উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ ১৬২৬৩ সার্বক্ষণিক কল সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য জানতে পারছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে। আবার জাতীয় তথ্য বাতায়ন ৩৩৩, সুখী পরিবার ১৬৭৬৭ এবং আইইডিসিআরের ১০৬৫৫ নাম্বারে ফোন করে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করতে পারেন। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই স্বাস্থ্য খাতে ই-ফাইলিং সেবা চালু করা হয়েছে, যা ক্রমে ‘পেপারলেস’ অফিস তৈরির পথে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে; যার ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তাকে ওই সম্মাননা দেয়া হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ ২০১৫ সালের আগেই অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জনে সফল হয়েছে। যার স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী এমডিজি অ্যাওয়ার্ড ২০১০, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।

এছাড়া ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী তনয়া সায়মা ওয়াজেদকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয় অটিজম বিষয়ে অবদানের জন্য ‘এক্সেলেন্স ইন পাবলিক হেলথ’ পুরস্কার প্রদান করে। ২০১৭ সালেও তাকে ‘গুড উইল অ্যাম্বাসাডর ফর অটিজম’ মনোনয়ন দেয়। এ ছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত অভিযোগ গ্রহণ ও পরামর্শের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা মূল্যায়নভিত্তিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিমোট ইলেক্ট্রনিক অফিস অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ডিএএচআইএস-২ সফটওয়্যারের বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ জন্য জার্মান সরকার ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে বেস্ট প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে এবং এ কোয়াইট রিভুলিউশন ইন হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ নামে একটি বিশেষ বই প্রকাশ করে। অনলাইনে প্রতিটি কমিউনিটির প্রসূতি মা ও অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের নিবন্ধন ও ট্র্যাকিং করার পদ্ধতি চালু হয়েছে। জিও কো-অর্ডিনেটভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রি চালু হয়েছে। এমবিবিএস এবং ডেন্টাল ভর্তিপরীক্ষার প্রতিটি স্তর ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিশ্ছিদ্র পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা হয়েছে। সর্বাধুনিক ডাটা সেন্টার এবং রিমোট ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এসিআর সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

চিকিৎসা শিক্ষায় ঘটেছে বিপ্লব : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষায় জোর দেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষাকে পৃথক করে ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর গড়ে তোলেন। বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ,  ছয়টি আর্মড ফোর্সেস ও আর্মি মেডিকেল কলেজ, একটি সরকারি ডেন্টাল কলেজ, আটটি ডেন্টাল ইউনিট, ১২টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, ১৪টি বেসরকারি ডেন্টাল ইউনিট, ২৮টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রতিষ্ঠান, ১৩টি স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রতিষ্ঠান, ৯টি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল, ২০০টি বেসরকারি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রশিক্ষণ স্কুল, ১১টি ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি এবং ৯৭টি বেসরকারি ইনস্টিটিউশন অব হেলথ টেকনোলজি পরিচালিত হচ্ছে।

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিলো না : দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিলো না। শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে সরকার গঠন করে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন শাহবাগ ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ও হাসপাতালকে (আইপিজিএমআর) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার প্রস্তাব দেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা যেমন রোগীর চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান চিকিৎসকদের উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ এবং সর্বশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। ৫০ বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সেন্টার অব মেডিকেল এক্সিলেন্স বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। উন্নত চিকিৎসাসেবা বিকেন্দ্রীকরণ, চিকিৎসা শিক্ষায় দক্ষ জনবল সৃষ্টি এবং গবেষণা কার্যক্রম উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনা রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে। সমপ্রতি খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় সফল কমিউনিটি ক্লিনিক : গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করেন। বাংলাদেশে এখন ১৪ হাজারের অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরে বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৮-তে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ কোটি বার মানুষ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা নিয়েছে এবং তাদের ৮৫ শতাংশই সেবায় সন্তুষ্ট। ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বরে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশে এসে মৌলভীবাজারে এক কমিউনিটি ক্লিনিক দেখতে এসেছিলেন। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কমিউনিটি ক্লিনিকটি পরিদর্শন শেষে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে আমি অবাক। জাতিসংঘে ফিরে গিয়ে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘স্বল্পখরচে গ্রামীণপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার যদি কোনো চিন্তাভাবনা কারো থাকে, তাহলে বাংলাদেশে গিয়ে দেখে আসতে হবে।

সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কর্মসূচি : স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দেশের শূন্য থেকে ১৮ মাস বয়সি সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি সন্তানধারণে সক্ষম সব নারীকে টিকাদানের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস করা, সংক্রামক রোগ থেকে ও পঙ্গুত্ব রোধ করা এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা— এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র ২ শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

ঘটেছে ওষুধ শিল্পের বিকাশ : ওষুধের মানসম্মত উৎপাদন ও দেশকে ওষুধে স্বনির্ভর করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তর গঠন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করেন। দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। গত ছয় বছরে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে পাঁচ থেকে ৩১ বিলিয়নে। ওষুধ খাত গার্মেন্টসের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাতে পরিণত হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রিপোর্টিং, নকল ওষুধ ও নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রয়ের বিষয়ে অনলাইনভিত্তিক অভিযোগ দাখিলের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। আমদানিকৃত এবং দেশে উৎপাদিত ওষুধের ব্লকলিস্ট অনলাইনে অনুমোদনের জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হয়েছে। এদিকে সরকারের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধিতে আরও সক্ষমতা অর্জনের জন্য গোপালগঞ্জে একটি বিশাল ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে। ২০১৬ সালে জাতীয় ওষুধনীতি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ওষুধ রপ্তানি বিগত বছরগুলোয় দ্রুতলয়ে বেড়েছে। ওষুধের কাঁচামাল দেশেই তৈরির জন্য মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একর জমিতে এপিআই পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। জাতীয় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রণীত পাঁচ বছর মেয়াদি ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি ২০১৭-২০২২’-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে মডেল ফার্মেসি ও মডেল  মেডিসিন শপ।

যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন : অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৮। সরকার জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬, মানবদেহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ২০১৮-সহ নানাবিধ আইন কাঠামো প্রণয়ন, জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠন করেছেন।

নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর গঠন : বাংলাদেশের নার্সিং ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পরিদপ্তরকে ২০১৬ সালের  ১৬ নভেম্বর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর হিসেবে উন্নীত করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখান থেকে বাংলাদেশের সরকারি খাতের নার্সিং ও ধাত্রীবিদ্যা সম্পর্কিত সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়।