Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

দেশে ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে আইন নেই

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১, ০৫:৫০ পিএম


দেশে ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে আইন নেই
  • ই-কমার্স নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি
  • মামলা হলেও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা
  • অনলাইনে প্রতারিত হয়েছেন মন্ত্রীও
  • জরুরি ভিত্তিতে আইন করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

অনলাইন কেনাকাটায় ঝুঁকছে মানুষ। এক ক্লিকেই মোবাইল ফোন, জুতা, ঘড়ি, থ্রি-পিস, শাড়ি চাইলেই পৌঁছে যাচ্ছে ভোক্তার দোরগোড়ায়। কেনাকাটার প্রবণতা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ঝুঁকিও। তবে প্রতারিত হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই।

সম্প্রতি ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ও ধামাকার মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করায় মানুষের মাঝে ই-কমার্স নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ই-কমার্সে শৃঙ্খলা আনতে নেই কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও। ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা নামে একটি নীতিমালা থাকলেও তাও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।

এ কারণে স্বেচ্ছাচারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্য আইনে মামলা হলেও ক্ষতিপূরণও পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ই-কমার্সের দৌরাত্ম্য। বাড়ছে প্রতারণাও।

আর এ সুযোগ নিয়েই অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এদিকে ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ নামে একটি আইন থাকলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দীর্ঘ তিন বছরেও মানসম্মত নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। ফলে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না প্রতারকদের। যেনো দেখার কেউ নেই। ই-কমার্সে প্রতারিত হয়েছেন মন্ত্রীও।

এমন অবস্থায় আইনজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট আইন ও রেগুলেটরি অথরিটি না থাকায় নিজেদের ইচ্ছামতো বেপরোয়াভাবে চলছে বেশির ভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তাদের নেই কোনো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। এমনকি আইন না থাকার কারণে মামলা হলেও বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে মানি লন্ডারিং আইনের দিকে। তাই দ্রুত একটি কার্যকরী আইন তৈরির তাগিদ দিয়েছেন তারা।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে এতদিন নির্দেশনা থাকলেও প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো শাস্তির কথা বলা হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের যত সমপ্রসারণ ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খাতটির ওপর গ্রাহকের হারানো আস্থা ফেরাতে আইন তৈরির সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছে। ই-কমার্স খাতে প্রতারণার প্রবণতা ঠেকাতে আলাদা আইন হওয়া দরকার। সেই বিষয়ে মন্ত্রণালয় করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১’ চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ভেটিংয়ের জন্য নির্দেশিকাটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে নিরাপদে বিনিয়োগের জন্য অবশ্যই একটি আইন থাকা দরকার। আইন না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো জবাবদিহি নেই। রাষ্ট্রের কাছে কোনো জামানতও নেই। এমনকি ফটকাবাজ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে  মামলা হলেও শুধু সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এর জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার। নইলে হয়রানির শিকার হতেই থাকবেন বিনিয়োগকারীরা। শুধু নীতিমালা বা নির্দেশিকা থাকলে হবে না, এ ছাড়া একটি ই-কমার্স রেগুলেটরি অথরিটিও থাকা দরকার, যারা সরাসরি তদারকি করবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নাজমা বেগম বলেন, ‘এসব অনিয়ম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রথম থেকে ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে ওঠে। তার মতে, হাতিয়ে নেয়া টাকা শতভাগ ফিরিয়ে দেয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। যখন ঘটনাটা ঘটে যায় তখন কিছু করার থাকে না। কারণ কোম্পানিগুলোর সম্পদের চেয়ে দেনার পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। সে জন্য তাদের ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও নেই।’

অধ্যাপক নাজমা বলেন, ‘আপনি তাদের ধরলেন, শাস্তি দিলেন কিন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের টাকা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়।’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ ইভ্যালি থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি পর্যন্ত কোনো ঘটনায়ই দায়ী ব্যক্তিদের কার্যকর কোনো শাস্তি হয়নি।

কথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মাধ্যমে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অন্তত ৫৪৩ কোটি টাকা। একই ধরনের প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধেও প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ধামাকা নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়েছে প্রায় ৫৮৩ কোটি টাকা। দক্ষিণবঙ্গ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।

এর আগে বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের কথা বলে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি-যুবক হাতিয়ে নেয় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বহুস্তর বিপণন পদ্ধতির (এমএলএম) নামে ‘ডেসটিনি-২০০০ লি.’ হাতিয়ে নেয় প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

এমএলএম কোম্পানি ‘ইউনি পে টু ইউ’ হাতিয়ে নেয় ৪২০ কোটি টাকা। পৃথিবীব্যাপী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু সাধারণ নীতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— ১. ব্যবসার অনুমতির জন্য লাইসেন্স সংগ্রহ করা, ২. শিপিং ও ডেলিভারি পলিসি, ৩. রিফান্ড পলিসি, ৪. অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নিশ্চিতকরণ, ৫. ক্রেতাদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা প্রদান, ৬. বয়স ও লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ, ৭. কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের সীমা, ৮. মৌলিক ব্যবসায়িক নীতি মেনে চলা।