Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ভোটে সাইবার যুদ্ধের মহাপ্রস্তুতি দলগুলোর

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

অক্টোবর ৩, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


ভোটে সাইবার যুদ্ধের মহাপ্রস্তুতি দলগুলোর

আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাইবার লড়াইকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। সব দলেই তৈরি হচ্ছে বিশেষ টিম। আলাদা আলাদা প্ল্যাটফরমে মহাপ্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। দেশের সঙ্গে দেশের বাইরেও থাকবে টিম। প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞদের বেতনভুক্তভাবেও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দুটো রাজনৈতিক দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রের এমনই ভাষ্য। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সরকারের উন্নয়ন ও অঙ্গীকার প্রচারণাকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্য কোনো গোষ্ঠী সরকারের নেতিবাচক প্রচারণা চালালে তা এখন থেকেই জবাব দিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের অনিয়ম, ব্যর্থতা নিয়ে বিশেষ ডকুমেন্টারি তৈরি করছে এক সময়কার রাষ্ট্র নেতৃত্ব দেয়া বিএনপি। দেশে এবং দেশের বাইরেও প্রচার মাধ্যমকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সমপ্রতি বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে দেখা গেছে এখন থেকেই রাজনৈতিক প্রচারণা। কয়েকটি পেজে শুধুমাত্র বিএনপির দুর্নীতি ও দুর্বলতাগুলো, আবার কোনো পেজে সরকারের ব্যর্থতা ও অপশাসন নিয়ে। এখন থেকেই মানুষের মাঝে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, আধুনিক জীবনে এক নতুন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গ্রামের চায়ের দোকানে মানুষ তথ্যের জন্য এখন আর পত্রিকার পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, পিন্টারেস্ট, টাম্বলার, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, স্ন্যাপচ্যাট, উইচ্যাট ইত্যাদিতে তথ্য পেতে চোখ রাখছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অগ্রপথিক হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক।

গতকাল রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে পল্টন চায়না টাওয়ারের সামনে দেখা গেছে পাঁচজন লোক একটি দোকানের সামনে জটলা বেঁধে ভিডিও দেখছেন। স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে বিরোধী পক্ষ হামলা করেছে। মুহূর্তেই তা ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে। এখান থেকেই ফের সঙ্গে সঙ্গে করণীয় কি, নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। ভিডিওটি আরও বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার দেয়া হচ্ছে। এলাকার সবাই এবং বিভিন্ন মানুষকে পার্সোনালভাবে ম্যাসেঞ্জারে পাঠানো হচ্ছে।

এছাড়া আটক থেকেও বাঁচতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেশি ব্যবহার করছেন। সমপ্রতি এক আলেমকে দেখা গেছে আটকের আগে ফেসবুক লাইভে এসে শঙ্কার কথা প্রকাশ করতে। এভাবেই দেশের সব মানুষের কাছে অনলাইন প্রচারণা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দলীয় নির্দেশনায় এখন থেকেই সরব রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গুজব ছড়ানো প্রতিহত’ করা হচ্ছে।

এছাড়া আগামী নির্বাচনের জন্য ‘সরকারের উন্নয়ন’ প্রচারছবি, পোস্টার, ভিডিও, গ্রাফিকসসহ নানা উপায়ে তারা ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। প্রচারণায় ফেসবুক, ওয়েবসাইট, ইউটিউব, টুইটারসহ নানা মাধ্যম ব্যবহূত হচ্ছে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে। দলীয় উইং থেকে বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে অনলাইনে প্রচারণায় অধিক গুরুত্ব দেয়ার। অন্যদিকে বিএনপি থেকে তৈরি হচ্ছে বিশেষ টিম। পাচ্ছেন অভিজ্ঞরা চাকরিও। আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা থাকবে সরকারবিরোধী প্রচারণা করা।

বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বড় আলোচনায় রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সর্বশেষ করোনাকালীন সময়ও দেখা গেছে স্কুল-কলেজ খুলে দিতে শিক্ষার্থীদের প্রচারণা। বেশ কয়েকটি দাবি আদায় ও বিচারকার্যেও ভূমিকা রয়েছে অনলাইন ফ্ল্যাটফর্ম। এছাড়া বাংলাদেশ রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘সাইবার যুদ্ধ’ প্রথমবারের মতো ব্যাপক আকার ধারণ করে ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীরা যেভাবে অনলাইন ব্লগ এবং সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন তেমনি ফেসবুকসহ ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা। পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণায় তোলপাড় তৈরি হয় দেশ-বিদেশে।

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই তথ্যপ্রযুক্তিকে বাংলাদেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আজ দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে ও নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্র সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরা এবং প্রচার-প্রচারণার জন্য প্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে আওয়ামী লীগ আরও গুরুত্ব দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, অনেক সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী, বাংলাদেশের উন্নয়নবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষের মাঝে আওয়ামী লীগ ও সরকারের উন্নয়নবিরোধী ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। এই সকল গুজন রোধ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তথ্যপ্রযুক্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আরও গুরুত্ব দেয়া হবে এবং সতর্ক থাকা হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশের সকল মানুষ ডিজিটাল সুবিধা গ্রহণ করছে। কিন্তু এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একশ্রেণীর অপপ্রচারকারী বিদেশে বসে সরকারবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ও উন্নয়নবিরোধী গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন তথ্য উপস্থাপন করে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার ও কিছু মানুষের স্বার্থরক্ষায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে।

এরা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু, উন্নয়নের শত্রু। তথ্যপ্রযুক্তিতে গুজব রোধে আগামীতে আরও গুরুত্ব দেয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তা হলে তার উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্স মাহমুদ আমার সংবাদকে বলেন, সরকার ও তার দলের লোকজন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মানুষ এসব প্রচারণায় কান দিচ্ছে না। সত্যটা এ দেশের মানুষ জানে। মানুষ এখন ভোট দেয়ার অধিকার হারিয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার হারিয়েছে। দেশে আজ লুটপাট চলছে। রাষ্ট্রীয় টাকায় যতই প্রচারণা চালানো হোক মানুষ অবশ্যই এগুলোতে কান দেবে না। সময়মতো ভোটের মাধ্যমে তার জবাব দেবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ২০২১-এর হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৯০ কোটির অধিক। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখ। ফেসবুক এখন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র তথা ব্যক্তিগত সমপ্রচার মাধ্যম। সাধারণ মানুষ চাইলেই কোনো মেইন স্ট্রিম গণমাধ্যমে দ্রুত কিছু প্রচার-প্রদর্শন করতে পারে না। কিন্তু ফেসবুকে তা সম্ভব। ফেসবুকের কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগের মাত্রা অতীতের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে। সমপ্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের নির্বাচনেও ফেসবুক অনেক বেশি গুরুত্বের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল বলেন, আগামী নির্বাচনে অনলাইন বিশেষ করে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে সারা পৃথিবীতে নির্বাচনি প্রচারণা এবং খবর আদান-প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের একাংশ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আরেকটি অংশ সরকারের বিভিন্ন কালাকানুনের ভয়ে স্বাধীন মতো সাংবাদিকতা করতে পারছে না। বর্তমানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করার জায়গা চরমভাবে সংকুচিত হওয়ার কারণে বিকল্প মাধ্যম হিসেবে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে।