Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

১৫ আলোচিত হত্যামামলা: ঝুলে আছে বিচারপ্রক্রিয়া

অক্টোবর ১১, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


১৫ আলোচিত হত্যামামলা: ঝুলে আছে বিচারপ্রক্রিয়া
  • শুনানির অপেক্ষায় শতাধিক আলোচিত মামলা
  • মোহাম্মদপুরে ১৩ হত্যা
  • সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বিলম্বিত হচ্ছে বিচারপ্রক্রিয়া
  • বিনাবিচারে দীর্ঘকাল কারাগারে থাকছেন আসামিরা
  • উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ও সাক্ষী হাজিরে গাফিলতি

নানা সংকটে বিচারে ধীরগতি চলমান। বিচারপ্রক্রিয়া গতিশীল করতে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। তবুও কাজের কাজ হচ্ছে না। দেশের নিম্ন আদালতগুলোয় শত শত চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে আছে। ফলে বিচারের আগেই দীর্ঘকাল কারাগারে থাকছেন আসামিরা। কেউ কেউ কারাগারে থেকেই মারা গেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর অনেকে আবার কনডেম সেলের বদ্ধ ঘরেই কাটাচ্ছেন বছরের পর বছর।

বছরেও তৈরি হয়নি পেপারবুক। উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় ঝুলছে বছরের পর বছর। বিচার শুরু হলেও তা চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। মূলত করোনা মহামারি, পুলিশ, প্রসিকিউশনের অদক্ষতা, তদন্তে সময়ক্ষেপণ, সাক্ষী হাজিরে গাফিলতি, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যায় মামলার জট বেঁধে আছে। দীর্ঘ ১৯ বছরেও শেষ হয়নি মডেল তিন্নি হত্যা মামলার বিচার।

২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় তিন্নির লাশ। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য (পলাতক) গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। কিন্তু অভি উচ্চ আদালতে একটি রিট করলে থেমে যায় মামলার বিচারকার্যক্রম।

পরে ওই রিটের নিষ্পত্তি হলেও বর্তমানে ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলাটির কেবল সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনার পর একই দিন খুনিদের দিিবদিক ছোঁড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরের শেরশাহ শুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। তবে ওই মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। সাক্ষী না আসায় থমকে আছে বিচার।

ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ বছর আগে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। তবে এতদিনেও মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। শুধু তিন্নির মামলায়ই নয়, এমন অনেক আলোচিত মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে দীর্ঘকাল।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কাছে মামলা ফাইল হওয়া থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ধাপে এটি দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়ে। এছাড়া তদন্তে সময় নেয়া, ঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া, অসংখ্যবার তারিখ নেয়া এবং আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়াও মামলা ঝুলে যাওয়ার বড় কারণ। আইন অনুযায়ী, বিচার বা মামলার তদন্তের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে সেটি মান্য করা হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যা, ফেনীর নুসরাত হত্যা, বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা, রানা প্লাজা হত্যা মামলা, অভিজিৎ হত্যা, নায়ক সালমান শাহ হত্যা, বাড্ডায় গণপিটুনিতে গৃহবধূ রেণু হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যা, গৃহবধূ সগিরা মোর্শেদ হত্যা, ব্লগার নিলয় হত্যা, মিরপুরের আফসানা ফেরদৌসের আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা, আবরার হত্যা, ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা, রমনায় মা-ছেলে হত্যা মামলাসহ অসংখ্য মামলা বিচারাধীন।  

আইন ও বিচার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাক্ষীর আদালতে হাজির না হওয়ার ঘটনাই বেশি। ভয়ভীতি ও হুমকির কারণে সাক্ষীরা অনেক সময় আদালতে আসেন না। দেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই। সাক্ষীদের আদালতে আনা-নেয়ার আলাদা কোনো ব্যবস্থাও নেই।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অবশ্য বলছেন, মামলাগুলোর বিচার যেভাবে চলছিল, তাতে গত বছরই শেষ হয়ে যেতো। করোনার কারণে তা হয়নি। এছাড়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, সাক্ষীর অনুপস্থিতি, সাক্ষ্যগ্রহণে বিলম্ব, দীর্ঘ সময় শুনানি মুলতবি এবং সাক্ষীদের মনোভাব পরিবর্তনের কারণে বিচারাধীন অধিকাংশ মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে বলে মনে করছেন।

তারা অভিযোগ করে বলেন, অনেক ফৌজদারি মামলার সাক্ষীকে সময়মতো আদালতে হাজির করতে পারছে না পুলিশ। ভাড়াটিয়া হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষীর বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে আদালতে দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য তো সাক্ষ্য দরকার।

আইনজীবীরা বলছেন, সাক্ষী আসেন না বেশিরভাগ খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, ধর্ষণসহ হত্যা, অস্ত্র ও ছিনতাই মামলার। ভয়ংকর অপরাধের এসব মামলায় সহজে কেউ আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে চান না। আইন অনুসারে মামলার অভিযোগ গঠনের পর আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করবে প্রসিকিউশন। এ দুই পক্ষের কাজের মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণেও সময়মতো সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায় না।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নানা কারণে বিচার বিলম্বিত হয়ে থাকে। এটা নতুন নয়। আলোচিত বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেড় বছর করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় অনেক মামলার শুনানি হয়নি। ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের কারণে অনেক মামলায় সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সাক্ষী অসুস্থ হলে বা মারা গেলে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। সঠিক সাক্ষ্য গ্রহণ না হলে মামলার অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অহেতুক কোনো ঠুনকো অজুহাতে মামলা শুনানি মুলতবি করা যাবে না। বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীকে মামলা নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রসিকিউশন ও পুলিশের গাফিলতির কারণে অনেক সময় বিচারে দীর্ঘসূত্রতা হয়ে থাকে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়ে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা হলে অবশ্যই সমাজে অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।