Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ভারতে কিডনি পাচার

নুর মোহাম্মদ মিঠু

অক্টোবর ১২, ২০২১, ০৬:২৫ পিএম


ভারতে কিডনি পাচার

দেশে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হলেও কৌশল পাল্টিয়ে এতদিন সক্রিয়ই থেকেছে কিডনি পাচারকারী চক্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চক্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করে পাঠাতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।

রোগীদের আত্মীয়ের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের দেখানো হতো দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কের জাল কাগজপত্র। রোগীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা দেখিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনকারীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো মোটা অঙ্কের অর্থ।

আর কিডনি বিক্রেতাদের সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে সমস্ত টাকাই পকেটস্থ করতো চক্রটি। এমন চক্র ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল জয়পুরহাট জেলায়। অনেক আগে এ চক্রের হাতেগোনা কয়েকজন ধরা পড়লেও গডফাদাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই। বছরের পর বছর ধরে আড়ালে থাকা সেসব গডফাদাররাই এই চক্রকে জিইয়ে রাখে।

ভয়ঙ্কর এই চক্রের সদস্যরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। পেজ খুলেই চলছিল কিডনি পাচারের এ কারবার। কিন্তু এরই মধ্যে তথ্য পেয়ে র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল অবৈধভাবে কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু করে।

তারই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর নর্দ্দা ছাড়াও জয়পুরহাট জেলায় অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এই চক্রটিই দীর্ঘদিন যাবৎ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আরেকটি চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে পাচার করে আসছিল দেশের সহজ-সরল, অসেচতন, অভাবগ্রস্ত মানুষদের কিডনি।

র‍্যাব জানায়, চক্রের সদস্যদের কেউ ‘কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন’ এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো, কেউ প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের অর্থের বিনিময়ে কিডনি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করতো। কিডনি কেনাবেচা ও পাচার চক্রের মূলহোতা শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ। দুটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল সে। এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষকে ভারতে নিয়ে কিডনি বিক্রির ব্যবস্থা করেছে শাহরিয়ার। ভারতে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে এসব অপকর্ম করে আসছিল ইমরান।

র‍্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে কিডনিসহ মানবদেহের নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে পড়ে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ, ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছে। আইন বহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের এমন কার্যক্রমে জড়িত চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে।

সমপ্রতি র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধ কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় র‍্যাব-৫, র‍্যাব-২ ও  র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার যৌথ অভিযানে জয়পুরহাট এবং রাজধানীর নর্দ্দা থেকে কিডনি ক্রয়-বিক্রয় সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ (৩৬), তার সহযোগী মেহেদী হাসান (২৪), সাইফুল ইসলাম (২৮), আব্দুল মান্নান (৪৫) ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজুকে (৩৮) আটক করে। অভিযানে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা সম্পর্কিত বেশকিছু কাগজপত্র, পাঁচটি মোবাইল এবং দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা জানায়, তাদের চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি বেচাকেনা করে থাকে। চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আর দ্বিতীয় গ্রুপ চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষ চিহ্নিত করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে। তৃতীয় গ্রুপটি প্রলোভনের শিকার কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে।

এরপর পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে কিডনি ডোনারকে এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করে। পরে অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায় তারা। এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথাও স্বীকার করেছে চক্রের সদস্যরা।

কমান্ডার মঈন বলেন, প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগীর কাছ থেকে নিতো ১৫-২০ লাখ টাকা। বিপরীতে কিডনি ডোনারকে দিতো মাত্র দুই লাখ টাকা। চক্রের মূলহোতা শাহরিয়ার ইমরান একেকটি কিডনি বাবদ পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা, মান্নান ও তাজুল কিডনি দাতা সংগ্রহ বাবদ যথাক্রমে পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টাকা নিতো। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই চক্রটি কোনো প্রকার রশিদ, পাসপোর্ট বা অন্যান্য প্রমাণ ডোনারকে দিতো না। চুক্তি অনুযায়ী কিছু অর্থ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ভিকটিমদের দমিয়ে রাখা হতো।

আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, শাহরিয়ার ইমরান পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করে। অনলাইনের মাধ্যমে বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতো ইমরান।

ইমরান ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসাসেবা’ এবং ‘কিডনি লিভার চিকিৎসাসেবা’ নামক দুটি পেজের এডমিন। এ পর্যন্ত কিডনি বিক্রির জন্য শতাধিক মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে সে। চক্রের অন্যতম সদস্য আব্দুল মান্নান মূলত কিডনি ডোনারদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এই অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করে। ইতোপূর্বেও এই অপরাধের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সে গ্রেপ্তার হয়। তার বিরুদ্ধে মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে। আটক হওয়া তাজুল ইসলাম মান্নানের সহযোগী হিসেবে কাজ করতো।

তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। অপর দুই সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান কিডনি ডোনারদের পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট, মেডিকেল ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করতো। এ কাজে তারা জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নিতো বলে স্বীকার করেছে।