Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

গ্রাহকবান্ধব দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত

নুর মোহাম্মদ মিঠু

অক্টোবর ১৮, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


গ্রাহকবান্ধব দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত

সারা বিশ্বেই অন্যতম বৃহৎ ক্ষুদ্রঋণ খাত হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ খাত। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহায়ক ক্ষুদ্রঋণ খাত বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই সনদ প্রদানসহ এ খাতের সার্বিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। দেশের বিশাল এই খাত ঋণ প্রদান ও সঞ্চয় গ্রহণের মাধ্যমে দেশের চার কোটিরও অধিক মানুষকে আর্থিক সেবার মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নমূলক বিভিন্ন সেবাও প্রদান করে যাচ্ছে। 

তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জুন অনুযায়ী সনদপ্রাপ্ত ৭৪৬টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় তিন কোটি ৩৩ লাখ গ্রাহককে ক্ষুদ্রঋণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা প্রদান করেছে সংস্থাটি। যে সংস্থা ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্ষুদ্রঋণ খাতকে কার্যকর, স্বচ্ছ ও যথাযথ নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সার্ভিস চার্জের হার ৩৫-৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রথমে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ২৪ শতাংশ, সঞ্চয়ের সুদের হার সর্বনিন্ম ৬ শতাংশ, ঋণের বিরতিকাল, ঋণক্ষতি সঞ্চিতি হিসাবায়নসহ ইত্যাদি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে এ খাতের উন্নয়ন ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বারোপ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। 

পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে মাইক্রোফাইন্যান্স রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেন্স ইউনিট প্রতিষ্ঠা ও স্টিয়ারিং কমিটি গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। তারও আগে দেশ স্বাধীনের পরপরই দেশের প্রান্তিক জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ভাগ্যোন্নয়নে ছোট বা ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের নির্দেশনা  দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর থেকেই রুরাল সোস্যাল সার্ভিস (আরএসএস) প্রকল্পের আওতায় ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম দেশে প্রবর্তিত হয় সুদ ও জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। যা আজ বিশ্বজুড়েই লাভ করেছে সুপরিচিতি। একই সাথে হয়েও উঠেছে গ্রাহকবান্ধব। 

এমআরএর দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন নাগাদ সংস্থাটির গ্রাহক সংখ্যা তিন কোটি ৩৩ লাখ, সঞ্চয় স্থিতি ৩৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৪৬টি আর শাখা সংখ্যা ২০ হাজার ৮৯৮টি। এ পর্যন্ত এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার ১১০ জনের, ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা ও বর্তমানে সংস্থাটির ঋণস্থিতি রয়েছে ৮৮ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এমআরএর সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। সনদের জন্য প্রাপ্ত আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডপত্র ও কার্যক্রম যাচাই-বাছাই করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সনদ প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে সন্তোষজনক কার্যক্রম পরিচালনা না করলে সনদ বাতিলও করে অথরিটি। 

চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৮৮০টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয়া হলেও সন্তোষজনক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম না হওয়ায় ১৩৪টি প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৭৪৬টি প্রতিষ্ঠানের দেশব্যাপী ২১ হাজার শাখায় পৌনে দুই লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। এর মধ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমআরএ থেকে তৃতীয়বারের মতো ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সনদ দেয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন আহ্বানের প্রেক্ষিতে এক হাজার ১৪০টি আবেদন পাওয়া যায়।  

শুধু সনদই নয়, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন ও সঠিক হিসাবায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিতেও নিয়মিত সরেজমিন পরিদর্শন করছে এমআরএ। পরিদর্শনের সময় প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম, হিসারবরক্ষণ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ও পরিচালনাগত বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষভাবে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহকদের সাথেও অথরিটির কর্মকর্তারা সরাসরি আলোচনা করে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কি-না সে বিষয়েও খতিয়ে দেখা হয়। 

গেলো অর্থবছরে ২৫৩টি প্রতিষ্ঠানসহ এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার বার এসকল প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করেছে সংস্থাটি। এ খাতের উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও এমআরএ নিজস্ব জনবলের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও দেশ-বিদেশে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত অথরিটির সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এমআরএ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে গ্রাহকদের আর্থিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণও দিয়ে আসছে। 

এ ছাড়াও সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিজস্ব তহবিল বা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা শিক্ষাকার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমসহ সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়মূলক কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গ্রাহকদের দারিদ্র্য নিরসনসহ সার্বিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের বছরভিত্তিক উদ্বৃত্তের প্রায় ২০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক কার্যক্রমেও। বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায়ও ফ্রন্ট লাইনার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ ৪৬৯ কোটি টাকা বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে ব্যয় করেছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধু ঋণই প্রদান করে না; পাশাপাশি ঋণের টাকা যথাযথভাবে বিনিয়োগ বা কাজে লাগাচ্ছে কি-না তাও ফলোআপ ও পরামর্শ দেয়াসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও করে থাকে। ফলে ঋণগ্রহীতারা ঋণের অর্থের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ কৃষি ও বিভিন্ন শিল্পসহ মৌসুমী ব্যবসা খাতেও ঋণ দেয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্ত করা দেশের তিন কোটি ৩৩ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশই নারী। বিগত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক সংখ্যা, সঞ্চয়স্থিতি, ঋণস্থিতি ও ঋণ বিতরণ ২.৪৮ কোটি জন, পাঁচ হাজার ৬১ কোটি টাকা, ১৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা ও ২৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা থেকে যথাক্রমে তিন কোটি ৩৩ লাখ জন, ৩৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, ৮৮ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা এবং এক লাখ ৩৬ হাজার ২৭৫ কোটি বৃদ্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। আর ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি পৌনে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান ছাড়াও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও আয় বর্ধনমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টিসহ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ দুর্যোগ মোকাবিলা ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করাকেও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এরই মধ্যে অন্যান্য খাতের মতো ক্ষুদ্রঋণ খাতের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে মহামারি করোনা। এ পরিস্থিতিতে আগের মতো ঋণ কার্যক্রম চালু এবং ঋণ বিতরণ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করাসহ ঋণ কার্যক্রম চলমান রেখে এ খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এমআরএ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উদ্যোগও গ্রহণ করে। করোনার শুরু থেকেই সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিতরণ, হাত ধোয়ার উপকরণ বিতরণ ও স্থাপন, জীবাণুনাশক দ্রব্যাদি বিতরণ, কোয়ারেন্টাইন ও চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন এবং অসহায় লোকদের জরুরি খাবার, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা দ্রব্যাদি বিতরণের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরে দরিদ্র গ্রাহকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের স্বার্থ রক্ষায় ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি-ঋণ বকেয়া কিংবা খেলাপি দেখানো যাবে না উল্লেখ করে সার্কুলার জারি করে এমআরএ। 

করোনাকালীন সময়ে কিস্তি আদায়ে গ্রাহকদের বাধ্য করা যাবে বরং গ্রাহকস্বার্থে আপদকালীন নতুন ঋণ দেয়ারও পরামর্শ দেয় এমআরএ। একই সময়ে গ্রাহক এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের যেকোনো সমস্যা সমাধানে মনিটরিং সেল গঠন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি প্রদান অব্যাহত রাখার নির্দেশনাও দেয় এমআরএ। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ এ খাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশাজীবী, কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে এবং ক্ষুদ্রঋণ সেক্টরের কৃষক, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য নতুন আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়নের কাজও চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।