Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ঢামেকে অজ্ঞান পার্টি ঠেকাতে বসছে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড

নুর মোহাম্মদ মিঠু

অক্টোবর ১৯, ২০২১, ০৯:৪০ পিএম


ঢামেকে অজ্ঞান পার্টি ঠেকাতে বসছে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড

চিকিৎসাক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পরম ভরসাস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক)। জটিল ও দুরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন এ হাসপাতালে। দিন-রাত সেবায় যেমন ব্যস্ত সময় পার করেন প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, তেমনি হাজারো মানুষের আনাগোনায় মুখরিত থাকে গোটা কম্পাউন্ড। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা রোগীদের স্বজনরা যেমন ব্যস্ত থাকেন সেবা নিতে, আর হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরাও ব্যস্ত থাকেন সেবা দিতে। 

এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে অজ্ঞান পার্টি, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীর সহজ-সরল স্বজনদের সঙ্গে মিশে অজ্ঞান করে লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব। এমন ঘটনা মাঝে কিছুটা কমলেও সাম্প্রতিককালে বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। গত সোমবার দিবাগত রাতেও ঢামেকে ঘটেছে এমন ঘটনা। এ নিয়ে গেলো দুই মাসে তিনটি ঘটনার কথা বলছে হাসপাতালটির পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (এসআই) বাচ্চু মিয়া। 

তিনি বলেন, কদিন আগেও এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে। জুসের বোতলে অজ্ঞান করার উপাদান মিশিয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। যদিও ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন কারণে অভিযোগ করতে চান না। সর্বশেষ সোমবারের ঘটনায়ও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেননি। পরে পুলিশের পক্ষ থেকেই শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এসব ঘটনায়  জড়িত অনেকে ধরাও পড়ে। কদিন আগের একটি ঘটনায় জড়িতরা নার্সিং কলেজের পাশ থেকে ধরা পড়ে; এখন তারা জেলে। তিনি বলেন, গাইনি বিভাগের একটি বেডে ২-৩ জন করে রোগী থাকেন। তাদের সঙ্গে ৩-৪ জন করে স্বজন। যে কারণে মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। এসব ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে আমরা মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানিয়েছি বলে আমার সংবাদকে জানান তিনি। 

সর্বশেষ সোমবার দিবাগত রাতের ঘটনা সম্পর্কে এসআই বাচ্চু মিয়া বলেন, এ ঘটনায় রোগীসহ তিন নারী স্বজনের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। রোগী মিতা আক্তার (২৫), তার ছোট বোন খুশি আক্তার (২০) ও আরেক রোগীর স্বজন শাহিনূরের সঙ্গে রাত দেড়টার দিকে ঢামেকের ২১২ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ অচেতন অবস্থায় ছটফট করতে থাকেন ওই তিন নারী। এ সময় ওয়ার্ডে কর্মরত স্টাফরা তাদের জরুরি বিভাগে নিয়ে স্ট্যাম্পক ওয়াশ করে আবার ওয়ার্ডে দিয়ে যান। 

ভুক্তভোগী খুশি জানান, মধ্যবয়সী এক নারী দুটি জুস ও একটি কেক দিয়ে বলেন, তোমার মা এসব পাঠিয়েছে, খেয়ে নাও। তখন আমার মা বাইরে ছিলেন। এরপর আর কিছু বলতে পারবো না। তিনি বলেন, আমাদের স্টম?াক ওয়াশ করার পর খোঁজ নিয়ে দেখি আমার বোনের স্বর্ণের কানের দুল, ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা ১০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে। ২১২ নম্বর গাইনি ওয়ার্ডের নার্সিং ইনচার্জ রওশন আরা বেগম জানান, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে যারা পড়েছেন, তারা এখন সুস্থ আছেন। 

ওয়ার্ড মাস্টার মো. আবু সাঈদ জানান, দুই মাসের ভেতরে তিনটি অজ্ঞান পার্টির ঘটনা ঘটলো। এখানে একজন রোগীর সাথে চারজন ভিজিটর আসেন। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এ সুযোগে রোগীর স্বজন সেজে কোমলপানীয়, জুস বা কেক খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। আমরা রোগীদের সব সময় বলি, অন্যের দেয়া কিছু খাবেন না। 

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক আমার সংবাদকে বলেন, এসব ঘটনায় জড়িতদের ধরে আমরা থানায় দিচ্ছি, তবুও ঘটছে। এর বড় সমস্যাই হচ্ছে রোগীর স্বজনদের অসচেতনতা, তারা সচেতন নন। হাজার হাজার রোগী আসছেন মেডিকেলে। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার রোগী আসছেন। এদের মধ্যে রোগীর স্বজন আর অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের আলাদা করে চেনার সুযোগ নেই— এটা আরেক বড় সমস্যা। তবে আমরা এসব ঘটনা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। তিনি বলেন, রোগীর স্বজনদের সচেতন করার জন্য আমরা ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও সচেতনতার পাশাপাশি তাদের ট্রেনিংও দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও আমরা গোটা মেডিকেলজুড়ে নোটিস বোর্ডে এসব ঘটনার বিষয়ে সাবধান থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। তবুও ঘটছে। এর কারণ হচ্ছে, যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা খুবই ধুরন্ধর। এরা রোগীর স্বজন পরিচয়ে হাসপাতালে এন্ট্রি নেয়। পক্ষান্তরে রোগীর স্বজনরা দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা এবং সহজ-সরল হওয়ায় খুব সহজেই এ চক্রের সদস্যদের প্রলোভনে পড়ে যায়। চক্রের সদস্যরা রোগীদের সেসব সহজ-সরল স্বজনদের টার্গেট করেই মেডিকেলে প্রবেশ করছে। আর তারা এমন এক সময় প্রবেশ করে, যখন তাদের চিহ্নিত করাও কঠিন। তারপরও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এসব ঘটনায় নিজস্ব কোনো লোক জড়িত কিনা— সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, চক্রগুলোকে ধরে পুলিশে দেয়া হয়। আগেও এমন ঘটনায় জড়িতদের অনেককেই পুলিশে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এরা আবার বেরিয়ে আসে। আর এ ঘটনাগুলো বেশি ঘটাচ্ছেন মহিলারা। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা দেখতে পেয়েছি, সর্বশেষ ঘটনাটিও এক মহিলা ঘটিয়েছেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে বোঝাই যাচ্ছে এরা খুবই ধুরন্ধর এবং এসব ঘটনায় অভ্যস্ত। এ ঘটনায় জড়িত মহিলার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, খুবই দ্রুততার সাথে কীভাবে জুসে অজ্ঞান করার উপাদান মেশাচ্ছে। 

সব মিলিয়ে এসব ঘটনা রোধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীর স্বজনদের সচেতন করার লক্ষ্যে আমরা পুরো মেডিকেলজুড়ে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করছি। ডিসপ্লে বোর্ডে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সার্বক্ষণিক প্রচার করা হবে। যাতে রোগীর সহজ-সরল স্বজনরা ভিডিও দেখে বুঝতে পারেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কীভাবে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে বা ঠকাচ্ছে। 

ঢামেক শাহবাগ থানাধীন এবং ঢামেকে পুলিশের যে ইউনিট সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে, সে ইউনিটও শাহবাগ থানারই— এমনটা জানিয়ে থানার ওসি মওদুত হাওলাদার আমার সংবাদকে বলেন, এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না, মামলা করলেই আমরা ব্যবস্থা নেব। কিন্তু মামলা না হলে আমরা কীভাবে ব্যবস্থা  নেব— এ এক বড় সমস্যা। অন্যদিকে এসব ঘটনা এড়ানোর জন্য যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সচেতনতা। রোগীর স্বজনদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ওয়ার্ডে পুলিশের ডিউটি থাকে না। পুলিশ ওয়ার্ডের বাইরে, রাস্তায় ডিউটি করে। কোনো ঘটনা ঘটলে বা ঘটনার আশঙ্কা থাকলেই ভেতরে যায়। আরও একটি সমস্যা রয়েছে; সেটি হচ্ছে অধিকাংশ সময় সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো সচল থাকে না। আর সেগুলো নষ্ট থাকায় এসব ঘটনায় আমরা তাৎক্ষণিক তথ্য পেয়েও অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আবার রোগীর স্বজনরাও অনেক সময় হাসপাতাল কম্পাউন্ডের বাইরে থেকে খেয়ে আসেন, আর অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা ঘটছে ভেতরে। সব মিলিয়ে এসব ঘটনা রোধে আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিলবোর্ড স্থাপনে পরামর্শ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনা মাঝে কিছুটা কমে এলেও সাম্প্রতিককালে আবার কিছুটা বেড়ে গেছে। যে কারণে আমরা আগের মামলাগুলোও এখন খতিয়ে দেখছি কারা এসব ঘটনায় জড়িত ছিল, এখন কারা ঘটাচ্ছে। আশা করি এসব পর্যালোচনা করে আমরা জড়িতদের পেয়ে যাবো। পূর্বের মামলাগুলোতে যাদের জেলে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারা ফের জামিনে বের হয়ে এসে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে কী না, তাও জানাতে পারবো।