Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

নেপথ্যের মূল হোতারা অধরা  

নুর মোহাম্মদ মিঠু 

অক্টোবর ২২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


নেপথ্যের মূল হোতারা অধরা  

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কুরআন রাখায় ঘটনায় ইকবালকে ‘ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে ধারণা তাদের।

যদিও নেপথ্যের হোতারা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। আটক ইকবালও এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি। বরং আটকের পর থেকেই অসংলগ্ন আচরণ করছেন বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র। 

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ঘটনার নেপথ্যে যারাই থাকুক, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে খুব শিগগিরই। এরই মধ্যে ঘটনার আট দিন পর বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কক্সবাজারের সুগন্ধা বিচ এলাকা থেকে ইকবালকে আটক করার কথা জানায় পুলিশ। আটকের পর পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন শরিফ রাখার কথাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন ইকবাল হোসেন। 

গতকাল শুক্রবার কুমিল্লার পুলিশ লাইন্সে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইকবাল কুরআন রাখার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। 

তিনি জানান, মণ্ডপে কুরআন রাখার পর হনুমানের মূর্তি থেকে গদা সরিয়ে নেয়ার কথাও পুলিশের কাছে বলেছেন তিনি। তবে কার নির্দেশে এই কাজ করেছেন, তা জানাননি ইকবাল। 

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, গ্রেপ্তারের পর থেকেই ইকবাল অসংলগ্ন আচরণ করছেন। কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে জেলা পুলিশ লাইন্সে নেয়ার পর থেকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট।

কুরআন শরিফ পাওয়ার এ ঘটনা ঘটে সমপ্রতি হিন্দু সমপ্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় পূজায় কুমিল্লার নানুয়ার দীঘিরপাড়ের অস্থায়ী একটি পূজামণ্ডপে। ওই ঘটনার জেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতাও সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

আর ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে কয়েকটি স্থানের সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে পুলিশ। সেসব ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনায় সম্পৃক্ত ইকবাল হোসেনকে শনাক্ত করে পুলিশ। সেসব ভিডিও ফুটেজ পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এসেছে আমার সংবাদের হাতেও। 

সিসিটিভির সেসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ৫০০ গজ দূরের দারোগাবাড়ি মাজারসংলগ্ন মসজিদ থেকে কুরআন নিয়ে মন্দিরে ঢোকেন ইকবাল হোসেন। গ্রেপ্তার ইকবাল হোসেন  যে কোনোভাবে, কখন মসজিদে যান এবং বের হন— এরপর মণ্ডপের দিকে যান ও মণ্ডপ থেকে গদা হাতে ফেরেন তা ফুটেজে অনেকটাই স্পষ্ট।

র‍্যাব, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, ইকবালকে ব্যবহার করে নেপথ্যে যারা ভূমিকা রেখেছে, এখন তাদের শনাক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। ইকবালের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরেই অনেকের মুখোশ উন্মোচন হবে বলে আশা করছেন তারা। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘ইকবাল কারও দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বা কারও প্ররোচনায় এটা করেছে বলে আমরা মনে করি। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সবকিছু উদ্ধার করতে পারবো। নোয়াখালীতে যারা সহিংসতায় জড়িত ছিলো, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তাকে আমরা চিহ্নিত করেছি। মাজারের সঙ্গে যে মসজিদ, সেখানে সে গেছে। একবার-দুবার নয়, তিনবার গেছে। সেখানে মসজিদের দুজন খাদেম ছিলো, তাদের সঙ্গে সে কথা বলেছে।’ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল কে এম আজাদ বলেন, ‘নাটকের প্রথম পর্বে ছিলো ইকবাল। পেছন থেকে আরও যারা এই নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তারাই মূলত আসল ‘খেলোয়াড়’।

 এদিকে সিসিটিভি ফুটেজে গত ১২ অক্টোবর রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে মসজিদে প্রবেশ করতে দেখা যায় মাজারের খাদেম ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুনকে। এরপর রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে মসজিদে প্রবেশ করেন ইকবাল। এ সময় খাদেম ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুন ইকবালের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়। ঠিক রাত ১১টায় তারা তিনজনই সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর রাত ২টা ১২ মিনিটের দিকে পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করে কুরআন নিতে দেখা যায় ইকবালকে। এ সময় পাশেই অজ্ঞাত একজন ঘুমিয়ে ছিলেন, আরেকজন ছিলেন নামাজরত অবস্থায়। এর দুই মিনিট পর মেঝেতে কুরআন রেখে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। তারপর রাত ২টা ১৮ মিনিটে মসজিদে আবারো প্রবেশ করে মেঝেতে রাখা কুরআন নিয়ে মসজিদ থেকে বের হতে দেখা যায় তাকে। মসজিদ থেকে বের হয়ে তাকে মূল সড়কে উঠে মন্দিরের দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ইকবাল পূজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পূজামণ্ডপের রোড থেকে জগন্নাথ মন্দির রোডের দিকে এগিয়ে যান। এরপর তিনি জগন্নাথ মন্দির রোড থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক চকবাজার শাখার দিকে এগিয়ে যান। পূবালী ব্যাংক মোড়ের পাশের গলিতে প্রবেশ করেন তিনি। সেখানে অবস্থান করে নৈশপ্রহরীদের সঙ্গে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায় তাকে। সর্বক্ষণই তার হাতে কুরআন দেখা যাচ্ছিল। কথাবার্তার পরে তাকে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে যেতে দেখা যায়। 

সেই রোডে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর পূজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যান ইকবাল। অন্য আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৩টা ১২ মিনিটে যুবকটির হাতে কুরআন শরিফ নেই। তিনি এ সময় গদা কাঁধে নিয়ে মন্দিরের পাশে পুকুরপাড়ের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এ সময় তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলেন কেউ তাকে দেখছে কি-না। চিহ্নিত ব্যক্তির প্রস্থানের একটু পরে রাত ৩টা ১৩ মিনিটের দিকে ৯৯৯ এ কল দেয়া একরামকে সেখানে দেখা যায়। 

এরপর তাকে আবার ৩টা ২৩ মিনিটের দিকে দারোগাবাড়ি মসজিদে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এসময় তার কাছে কুরআন কিংবা গদা কিছুই দেখা যায়নি। এরপর ১৩ অক্টোবর পুকুরপাড়ে উত্তেজিত জনতার সামনে তাকে কথা বলতে দেখা যায়।শারদীয় দুর্গাপূজার মহাঅষ্টমীর দিন গত বুধবার ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির উত্তরপাড়ে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন দেখা যায়। 

এরপর কুরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মণ্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। এরপর রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু বসতিতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হিন্দুদের মন্দির-মণ্ডপসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়েছে দেশের আরও কয়েকটি এলাকায়। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, নানুয়ার দীঘিরপাড়ের পূজামণ্ডপে শুরুতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ইকবাল হোসেন। পূজামণ্ডপটিতে শুরুতে ইকবাল লোকজন দেখে ফিরে আসেন। 

এরপর তিনি গিয়েছিলেন ওই মণ্ডপের অদূরে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে। সেখানে গেটের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার ফিরে আসেন নানুয়ার দীঘিরপাড়ের পূজামণ্ডপে। সেখানে ওই সময় লোকজন না থাকার সুযোগ নিয়ে তিনি কুরআন শরিফ রেখে যান। ওই ঘটনায় ইকবাল ছাড়াও তার সহযোগী সন্দেহে ইকরামসহ অন্তত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

তাদের মধ্যে কুমিল্লা নগরীর শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি রা.-এর মাজারের সহকারী খাদেম হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন আহমেদ ও ফয়সাল আহমেদও রয়েছেন। এই মাজারের মসজিদ থেকেই কুরআন নিয়ে মণ্ডপে রাখেন ইকবাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, ইকবাল গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত এবং আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

যেভাবে গ্রেপ্তার ইকবাল : ঘটনার পর কক্সবাজারের ঘুরতে যাওয়া ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে গানে গলা মিলিয়ে ধরা পড়েন অভিযুক্ত ইকবাল। ছাত্রলীগ কর্মী ও চৌমুহনী সরকারি এসএ কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের মাস্টার্সের ছাত্র অনিক রহমান দাবি করেন, ‘আমি ও বন্ধু মেহেদী হাসান মিশু এবং সাইফুল ইসলাম সাইফ মিলে ইকবালকে ধরিয়ে দিয়েছি। ওই তিনজনকে ছাত্রলীগের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান। 

এদিকে ছাত্রলীগ কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লা ও কক্সবাজার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালকে ধরা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালীর (বেগমগঞ্জ সার্কেল) এএসপি শাহ ইমরান। 

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ কর্মী অনিক ও মিশু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালের তথ্য দেন। তারা ইকবালকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা চান। পরে আমি কুমিল্লা ও কক্সবাজারের পুলিশের সঙ্গে ইকবালকে গ্রেপ্তারের জন্য যোগাযোগ করি। 

ইকবালকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বলতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী অনিক বলেন, ‘গত ১৯ অক্টোবর রাতে বন্ধু মেহেদি হাসান মিশু ও ঢাকার তিন ব্যবসায়ী বন্ধু রায়হান, মামুন ও হূদয়সহ পাঁচজন কক্সবাজার বেড়াতে যাই। বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে থাকা আরেক বন্ধু সাইফুল ইসলাম সাইফ আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর বিকেল ৪টায় দরিয়ানগরে ঘুরতে বের হই। সেখানে ছয় বন্ধু মিলে সময় কাটাতে গান গাওয়ার সময় ইকবালও পাশে এসে গানে সুর মেলায়। এরপর ওই রাতে টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে ছবি দেখে ইকবালের বিষয়ে নিশ্চিত হই।’ 

এসএ কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ কর্মী মেহেদী হাসান মিশু বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে তারা সুগন্ধা পয়েন্টে গেলে ইকবালের সঙ্গে তাদের আবার দেখা হয়। তখন আমরা তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলি। এক পর্যায়ে সে পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে নাশতা ও সিগারেট খাইয়ে কৌশলে আটকে রাখি। এসময় তার নাম জানতে চাইলে সে ইকবাল বলে জানায়। তখন আমরা কৌশলে তার ছবি তুলি, নোয়াখালীর এএসপির সঙ্গে যোগাযোগ করি ও ছবি পাঠাই। তিনি আমাদের কুমিল্লার পুলিশ সুপারের মোবাইল নম্বর দেন। এরপর কুমিল্লার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি পাঠাই। তিনি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশ এসে ইকবালকে আটক করে নিয়ে যায়।’