Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৭ মে, ২০২৫,

সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার ও অধিদপ্তর উন্নীত করা হচ্ছে বিশ্বমানে

অক্টোবর ২৫, ২০২১, ০৯:৪০ পিএম


সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার ও অধিদপ্তর উন্নীত করা হচ্ছে বিশ্বমানে

গণতান্ত্রিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গণগ্রন্থাগার। সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, অর্জিত শিক্ষার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, সশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধের বিকাশ এবং সর্বোপরি আর্থসামাজিক প্রয়োজনে তথ্য পরিবেশনসহ প্রভৃতি কাজে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। একটি জ্ঞানদ্দীপ্ত আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগার আলোকিত মানুষ তৈরি করে। 

আর সে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তরুণ প্রজন্মসহ দেশের যেকোনো শ্রেণিপেশার মানুষকে গ্রন্থাগারমুখী করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোও। কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারসহ দেশের গণগ্রন্থাগারগুলোকেও ডিজিটাল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার ও অধিদপ্তর ভবনটিও ভেঙে উন্নত বিশ্বের আদলে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত গণগ্রন্থাগারে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমার সংবাদকে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক। এ ছাড়া ১৮ হাজার পুস্তকের স্ক্যান করে ই-বুক তৈরির মধ্য দিয়ে ই-গ্রন্থাগার যুগেও প্রবেশ করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

গণগ্রন্থার অধিদপ্তরের পরিচালক মোছা. মরিয়ম বেগম আমার সংবাদকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ সারা দেশে ৭১টি সরকারি লাইব্রেরি রয়েছে। শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, সবাই যেনো লাইব্রেরিমুখী হয় সে জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ বা ইনোভেশন আইডিয়াও গ্রহণ করে থাকে অধিদপ্তর। এ বছরও নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি রংপুরের একজন সহকারী পরিচালক ‘লাল চায়ের আড্ডা’ নামে একটি ফ্লাটফর্ম তৈরি করেছেন, যেখানে বিভিন্ন বয়সি যে কেউই এসে বসতে পারেন, পড়তে পারেন। আরেকজন জানিয়েছেন বিব্লিউ থেরাপির কথা। যেমন— লাইব্রেরিতে এলে কোন বই পড়লে কি কাজে লাগে অর্থাৎ বই পড়ে মেডিকেল সম্পর্কেও জানা।’  

ই-গ্রন্থাগার যুগে প্রবেশের বিষয়ে অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক হামিদুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের একটা প্রকল্প ছিলো ‘অনলাইন লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগারে থাকা দুই লাখেরও বেশি বইয়ের ডাটাবেজ আমাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করা আছে। বইয়ের সার্বিক তথ্যাদি অনলাইনে আপডেট করেছি। পাশাপাশি ১৮ হাজার পুস্তকের স্ক্যান করে ই-বুকেও রূপান্তর করেছি। যদিও এখনো তা দৃশ্যমান হয়নি কপিরাইট অ্যাক্টের কারণে। যে কারণে পাঠকের জন্য এখন পর্যন্ত উন্মুক্ত করা হয়নি। তবে কপিরাইট অ্যাক্টের ঝামেলা মিটে গেলেই এটি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে অধিদপ্তরের।’ 

তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক পত্রিকা আছে, বই আছে। সবই আমরা স্ক্যান করে প্রক্রিয়াধীন রেখেছি। আর এসব উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই আমরা ই-গ্রন্থাগার যুগে প্রবেশ করবো। তবে এখন পর্যন্ত বইয়ের লেখক, প্রকাশকসহ বাহ্যিক সার্বিক তথ্যাদির ডিটেইলস তথ্য দেয়া থাকলেও পড়ার উপযোগী হয়নি এখনো। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ১৮ হাজার বই পড়ার উপযোগী করে আপলোড করতে না পারলেও অন্তত চার-পাঁচ হাজার বই উন্মুক্ত করা হবে এবং পাঠকরা এসব বই পড়তে পারবেন। 

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির বিষয়ে জানতে  চাইলে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের মাধ্যমে অধ্যাপক আবদুল্লা আবু সায়ীদ দেশব্যাপী যে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালনা করতেন সেটা এখন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। সারা দেশে ৭৬টি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে তথ্য দিচ্ছে। অবকাঠামোগত সবই আগের থাকলেও ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্পটিই এখন অধিদপ্তরাধীন। তাদের কাছ থেকে অধিদপ্তর সেবা ক্রয় করছে।’ 

এদিকে চট্টগ্রামেও প্রায় ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স  নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক মরিয়ম বেগম। যেখানে থাকবে ১৫তলা বিশিষ্ট একটি লাইব্রেরি, ১০ তলাবিশিষ্ট অডিটোরিয়াম এবং শহীদ মিনারসহ উন্মুক্ত মঞ্চ, ফুড কোর্ট ও ক্যাফেটেরিয়া। এই কমপ্লেক্স নির্মাণের পর ছোট-বড় মিলিয়ে চারটি অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে যে কেউই সাংস্কৃতিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা করতে পারবে বলে জানান তিনি। 

তিনি বলেন, ‘ঢাকা এবং চট্টগ্রামে একমাত্র দুই শিফটে লাইব্রেরি চলে। আর দেশের অন্যসব জায়গায় ৯টা-৫টা। আমরা আন্তরিকতার সাথে পাঠককে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া ১২ মাসে প্রায় ১৪-১৫টি অনুষ্ঠান করে থাকে অধিদপ্তর। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন-মৃত্যুবার্ষিকী, ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন, শেখ কামাল, শেখ জামালসহ শেখ রাসেল দিবস ছাড়াও দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদেরও জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর।   

সহকারী পরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, সারা দেশে অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৭১টি সরকারি লাইব্রেরি রয়েছে। এর মধ্যে ৬৪টি জেলা লাইব্রেরি, তিনটি উপজেলা লাইব্রেরি, চারটি শাখা লাইব্রেরি। এ ছাড়া সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের লাইব্রেরি থাকলেও একমাত্র সরকারি লাইব্রেরিই সবার জন্য উন্মুক্ত। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত, সবার জন্য উন্মুক্ত। দেশের যেকোনো শ্রেণিপেশার যে কেউই এ লাইব্রেরিতে এসে বিনা পয়সায় জ্ঞানার্জন করতে পারে। তাদের জন্যই প্রতি বছর কেনা হয় নতুন নতুন বই। ডিজি মহোদয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সারা দেশে অধিদপ্তরের একটা টিম নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। 

যাতে দেশের মানুষকে সহজেই তথ্যসেবা দেয়া যায়। পাঠক যেনো লাইব্রেরিমুখী হয় সে জন্যও প্রতি বছর নানা ধরনের প্রোগ্রাম করে অধিদপ্তর। জাতীয় দিবসগুলো ছাড়াও মতবিনিময়, আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের যারা কর্মকর্তা রয়েছেন তারাও বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মোটিভেট করছেন। হামিদুর রহমান বলছেন, আমাদের এখানে বেশির ভাগই তরুণ পাঠক, পাশাপাশি গবেষকরাও আসেন। মোটকথা, সব ধরনের পাঠকই আমাদের এখানে আসেন। 

অধিদপ্তরের পরিচালক মরিয়ম বেগম জানিয়েছেন, বর্তমানে যে ভবনে রয়েছে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার ও অধিদপ্তর, সেটি ভেঙে অত্যাধুনিক ভবন তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি আধুনিক বিশ্বমানের লাইব্রেরি হবে এটি। এখানে একটা ফ্লোর উন্মুক্ত থাকবে প্রতিবন্ধীদের জন্য, শিশুদের জন্য ও সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যও। উন্নত বিশ্বের আদলে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সবই থাকবে নতুন ভবনে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণগ্রন্থাগারে পাঠকের জন্য অবারিত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেকোনো বয়সের পাঠক, যেকোনো পেশার পাঠক এখানে এসে পড়তে পারেন। পাশাপাশি এখান থেকে বই বাসায় নিয়েও পড়তে পারবেন, যদি মেম্বারশিপ থাকে।  

অধিপ্তরের প্রকৌশলী মাকছুদুর রহমান আমার সংবাদকে বলছেন, পাঠকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য অনলাইন লাইব্রেরি সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এটাকে নতুন ভবনে আরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন করে, সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করে শুধু দেশেই নয় বরং দেশের বাইরের পাঠকদেরও যেনো কানেক্ট করা যায় সে প্রয়াস চলছে। দেশ-বিদেশে; যে যেখানেই থাকুক সিনিয়র সিটিজেনরাসহ সব পাঠকই যেনো ঘরে বসেই আমাদের বই পড়তে পারেন। 

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমরা নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বের বেশক’টি দেশে ঘুরেছি এবং দেখেছি সেখানকার লাইব্রেরিগুলো কীভাবে সার্ভিস দেয়। সে আদলেই সব ধরনের সুবিধা রেখেই আমরা নতুন ভবনটি নির্মাণ করতে যাচ্ছি। 

তিনি বলেন, উন্নত লাইব্রেরি হচ্ছে— ‘ইনশিয়াল স্টেজ অব লার্নিং’। উন্নত বিশ্বে লাইব্রেরির ডে-কেয়ার সেন্টারে বাচ্চাদের মা-বাবারা বাচ্চাদের রেখে কর্মস্থলে যান। লাইব্রেরির সেই ডে-কেয়ার সেন্টারে অক্ষর খেলে খেলেই বাচ্চারা অক্ষরজ্ঞান অর্জন করছে। প্রাথমিক শিক্ষার পুরোটাই লাইব্রেরি থেকে অর্জন করছে বাচ্চারা। আমরাও সেই আদলেই নতুন ভবনে ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা রেখেছি। যদিও আগে আমাদের দেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার সেভাবে গড়ে ওঠেনি বলে এতদিনেও এ সার্ভিসটি আমরা দিতে পারিনি। 

যেখানে উন্নত বিশ্বে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে, কমিউনিটিতে একটি করে লাইব্রেরি রয়েছে,  সেখানে আমাদের দেশে সে পরিবশে এখনো গড়ে ওঠেনি বলেই লাইব্রেরিগুলোও এখনো সে মানের সার্ভিস ওরিয়েন্টেড হয়ে গড়ে ওঠেনি। আমরা উন্নত বিশ্বের সেসব দেশ ঘুরে এসে এসব সার্ভিসগুলোই এখন অত্যাধুনিক নতুন ভবনে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছি। যদিও আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করছি যাতে সাধারণ মানুষকে যেনো উন্নত বিশ্বের আদলে টোটাল সার্ভিস প্রোভাইড করতে পারি। 

তিনি আরও বলেন, সিনিয়র সিটেজেনদের জন্যও আমরা নতুন ভবনের একেবারে টপ ফ্লোরের ডিজাইন করেছি। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশনাল সিস্টেম, সার্ভিস সিস্টেমের সাথে মিল রেখেই আমাদের নতুন ভবনের ডিজাইন করা হয়েছে। অনেক কিছুতেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধাকে সর্বোচ্চ প্রাদান্য দিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’