Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ট্রাইব্যুনাল থাকলেও আপিলের সুযোগ নেই

নভেম্বর ৭, ২০২১, ০৬:১০ পিএম


ট্রাইব্যুনাল থাকলেও আপিলের সুযোগ নেই
  • উপেক্ষিত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা 
  • ৪৩ ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা প্রায় সাড়ে তিন লাখ
  • ১৭ বছরেও আপিল ট্রাইব্যুনাল না হওয়ায় হাইকোর্টের বিরক্তি প্রকাশ 
  • আপিলের সুযোগ না থাকা চরম হয়রানিমূলক — বলছেন বিশেষজ্ঞরা

কাগজ আছে, দখল নেই। কারো আবার দখল আছে, কাগজ নেই। একজনের জমি রেকর্ড হয়েছে আরেকজনের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকের নাম ও জমির পরিমাণও ভুল লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার জমির দাগ নম্বরও ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। 

যেনো সমস্যার অন্ত নেই। সহজে সমাধানেরও উপায় নেই। দেশে জমিজমা সক্রান্ত বিরোধের শেষ নেই। শেষ নেই মামলা-মোকদ্দমারও। দেশের ৭০ শতাংশ ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হয় ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে। জমির মালিকানা শনাক্তে সিএস, আরএস, এসএ এবং বিএস খতিয়ান রয়েছে। 

এসব খতিয়ানের মধ্যে সর্বশেষ করা বিএসে ভুলের শেষ নেই। সামান্য ভুলেই বিচারপ্রার্থীদের ভুগতে হচ্ছে বছরের পর বছর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুগ যুগেও মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মামলা চলছে বংশ পরম্পরায়। জটিলতা নিরসনে সরকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও পদে পদে রয়েছে নানারকম বিড়ম্বনা। 

২০১২ সালে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল হলেও আইন হওয়ার দীর্ঘ বছরেও গঠন হয়নি আপিল ট্রাইব্যুনাল। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ফলে বাড়তি মামলার চাপে ভুগতে হচ্ছে উচ্চ আদালতকে। দীর্ঘ ১৭ বছরেও আপিল ট্রাইব্যুনাল না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্টও। 

গত ২৬ সেপ্টেম্বর আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়ায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বিরক্তি ও হতাশা প্রকাশ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্ট এক রায়ে অনুলিপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আদালতকে অবহিত করতে ভূমিসচিবকে নির্দেশ দেন। তবে  দেড় বছরেও সেই আদেশের বাস্তবায়ন লক্ষ করা যায়নি।

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু জরিপ ট্রাইব্যুনালই নয়, সেই সাথে আপিল ট্রাইব্যুনাল থাকাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু আপিলের সুযোগ না থাকা চরম হয়রানিমূলক বিষয়। দ্রুত আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। এছাড়া বিদ্যমান আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার কথা বলা হয়। 

কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল আর স্থাপন করা হয়নি। ফলে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি ও আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকার পেতে বিচারপ্রার্থীদের হাইকোর্টে রিট করতে হয়। 

এছাড়া একেকটি মামলা শুনানির তারিখ ধার্য করতে হচ্ছে ছয় মাস থেকে এক বছর পরপর। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়ছে। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এই প্রতিবেদন দেয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঝুলে ছিলো প্রায় সাড়ে তিন লাখ মামলা। এসব মামলার মধ্যে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন। বিচারিক আদালতে রায় হওয়া প্রায় দেড় লাখ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিট নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন হাইকোর্টে। এ সংক্রান্ত হাইকোর্টে দায়ের হওয়ার রিটের রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ১১ হাজার আপিল ঝুলে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নসীব কায়সার বলেন, ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ২০০৪ সালে সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা রয়েছে। সংশোধনীর পর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলেও আপিল ট্রাইব্যুনাল এখনো গঠন করা হয়নি। ফলে ট্রাইব্যুনালে হারলে সংক্ষুব্ধদের সরাসরি উচ্চ আদালতে আসতে হয়। এটা বিচারপ্রার্থী ও উচ্চ আদালত উভয়ের জন্য বিরক্তিকর। 

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল আমার সংবাদকে বলেন, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলাজট দীর্ঘদিনের সমস্যা। আসলে সংক্ষুব্ধদের আপিল করার সুযোগ না থাকায় জট দিন দিন বাড়ছে। মামলাজট নিরসনে পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ট্রাইব্যুনালে মামলা হারলেই উচ্চ আদালতে আসতে হয়। 

এতে উচ্চ আদালতেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়, সেই সাথে বিচারপ্রার্থীদের চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই দ্রুততার সাথে প্রতি জেলায় আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা সময়ের দাবি। মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে তদারকি ও মনিটরিং করা উচিত এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে।

ফরিদপুর জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোসাদ্দেক আহম্মেদ বশির আমার সংবাদকে বলেন, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এর সমাধান সহজ নয়। সংশ্লিষ্টরাও এদিকে খুব বেশি নজর দেন না যার জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের। 

আসলে একটা জেলা আদালতে যতগুলো ক্রিমিনাল মামলা আছে, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি মামলা আছে ওই জেলার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। এটা খুবই ভয়াবহ বিষয়। এই মামলাগুলো হওয়ার প্রধান কারণ হলো— ভূমি জরিপে গাফিলতি ও ভুল থাকা। আর মামলাজটের প্রধান কারণ হলো 

এসব মামলার শুনানির তারিখ পড়ে চার-পাঁচ মাস পরপর। যার জন্য মামলা বাড়তে থাকে কিন্তু নিষ্পত্তির সংখ্যা বাড়ে না। আবার সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার সুযোগ না থাকাও আরেকটি কারণ। তাই দ্রুত আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সেই সাথে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা অতি জরুরি। না হলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে।’