Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

শিক্ষক-কর্মচারী নির্যাতনে টর্চার সেল!

নভেম্বর ৯, ২০২১, ০৭:১৫ পিএম


 শিক্ষক-কর্মচারী নির্যাতনে টর্চার সেল!

রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। দেশের প্রথম এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। তাদের প্রধান দাবি— শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্যাতনের জন্য তৈরি টর্চার সেল বন্ধ করা। অধ্যক্ষের পদত্যাগসহ ১৪ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকরা গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্কুলের সামনে সড়ক অবরোধ করেন। 

শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার  রাতে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এর আগে তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অর্থ তছরুপ, শিক্ষক-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট না দেয়াসহ অবসর নেয়া শিক্ষকদের পেনশন সুবিধা আটকে রাখার অভিযোগে দিনভর শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করলে তিনি রাতে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

এর আগে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্দোলনরত এক শিক্ষক জানান, ‘স্কুলের লাল বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় কর্নারে একটি রুম আছে। অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে ওই টর্চার সেলে নিয়ে যায় অধ্যক্ষের লোকজন। সেখানে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এতেও কাজ না হলে চাকরিচ্যুত করা হয়। ইতোমধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্কুলের শিক্ষক শাহ আলম, নাসির উদ্দিন, ফয়সাল শামিম ও সহকারী প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। চাকরিচ্যুত হয়েছেন তিনজন।’

গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষকরা। এরপর দুপুরে তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে ঢাকা ডিভিশনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের রাস্তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানালে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে অবস্থান নেন। সেখানে তারা ১৪ দফা দাবি তুলে ধরেন। 

শিক্ষকদের দাবিগুলো হলো— শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্যাতনের জন্য টর্চার সেল বন্ধ করা, বরখাস্তকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বপদে বহাল, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য ভাতা প্রদান, দীর্ঘদিন যাবৎ কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের স্থায়ী করা, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বৈশাখী ভাতা প্রদান, বকেয়াসহ ইনক্রিমেন্ট দেয়া, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে সকল পদায়ন বাতিল করা, আগের মতো সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে অধ্যক্ষ নিয়োগ, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করা, অধ্যক্ষের অফিসে রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করা, এনটিআরসিএ ব্যতীত সকল নিয়োগ বন্ধ করা, বিধি মোতাবেক জ্যেষ্ঠতা প্রদান এবং সরকারি কর্মকর্তাকে সভাপতি করে বিশেষ গভর্নিং বডি গঠন। 

শিক্ষকদের অভিযোগ, স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ না দিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর যাবৎ অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে পদটি দখল করে আছেন আবুল হোসেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অধ্যক্ষের পদ দখল করে আছেন তিনি। এছাড়া তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ঠুনকো অজুহাতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয়। 

এছাড়া স্কুল পরিচালনা কমিটির মেয়াদ গত ২২ অক্টোবর শেষ হয়ে গেলেও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি প্রভাতি শাখায় মৌটুসী নামের একজন শিক্ষককে ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়োগ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন প্রভাতি শাখার একজন সিনিয়র শিক্ষক। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (সন্ধা ৬টা) অধ্যক্ষ অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। 

শিক্ষকদের আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষক প্রতিনিধি ফয়সাল শামিম বলেন, ‘অবৈধ অধ্যক্ষের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে। আমাদের কয়েকজন প্রতিনিধি ডিসি মহোদয়ের কাছে গেছেন। প্রতিনিধিদল আসার পর আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।’

ঢাকা বিভাগের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘শিক্ষকরা রাস্তা অবরোধ করলে আমরা জনদুর্ভোগ এড়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করি। শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করলে আমরা তাদের কথা শুনেছি। সিদ্ধান্তের জন্য ডিসি মহোদয়ের কাছে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল গেছে।’

রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘রাস্তা অবরোধের খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।’ 

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ মো. আবুল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কোনো কমিটি না থাকায় শিক্ষকরা সুযোগ বুঝে আমাকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ কাজ করেছে। তাদের কয়েকটি দাবি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বাকি অভিযোগ সত্য নয়।’ 

টর্চার সেলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ভুল, এখানে এমন কিছু নেই। নতুন কমিটি গঠন হলে শিক্ষকদের দাবি কমিটির কাছে পেশ করা হবে। 

স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক (ইংরেজি ভার্সন দিবা শাখা) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতিতে শিক্ষকরা অতিষ্ঠ। বিষয়ভিত্তিক (পদার্থ, রসায়ন) শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বাণিজ্য করে অপ্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। অবৈধভাবে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের পদ দখল করে আছেন। নিয়ম অনুযায়ী সহকারী প্রধান শিক্ষক দায়িত্বে থাকার কথা। কিন্তু নানা কৌশলে তিনি এ পদ দখল করেছেন। অথচ তার সিনিয়র আরও কয়েকজন আছেন। একবার পদ দখল করে এখন আর স্থায়ী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেন না। 

এভাবেই ছয় বছর ধরে লুটেপুটে খাচ্ছেন তিনি ’ অভিভাবক মাকসুদা ও কামরুন্নাহার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, করোনার পর ক্লাস শুরু হতে না হতেই আবার আন্দোলন। বাচ্চাদের পড়ালেখা নিয়ে কারো কোনো চিন্তা নেই। তবে শিক্ষকরা যৌক্তিক দাবিতেই আন্দোলন করছেন বলে মনে করেন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোস্তফার অভিভাবক। অন্যদিকে শিক্ষকদের আন্দোলনের সাথে সমর্থন রয়েছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীরাও সড়ক অবরোধে অংশ নেয়। তাদের দাবি, অধ্যক্ষের পরিচালনার দুর্বলতার কারণে স্কুলে কোনো শৃঙ্খলা নেই। 

আবরার বলেন, দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে এই স্কুলে পড়ছি, যখন সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলো তখন একটা শৃঙ্খলা ছিলো। এখন একেবারে এলোমেলো, তাই আবার সেনাবাহিনী থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া উচিত।’