Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

অছাত্রতে ঠাসা বর্তমান কমিটি

আহমেদ ইউসুফ

নভেম্বর ১৯, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


অছাত্রতে ঠাসা বর্তমান কমিটি

হ-য-ব-র-ল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ছাত্রলীগের রাজনীতি। অছাত্র আর চাকরিজীবী এবং বিবাহিতদের নিয়েই চলছে বর্তমানে সংগঠনটি— যা নিয়ে ক্ষুব্ধ নতুন পদপ্রত্যাশীরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করে যখন নেতৃত্বের স্বাদ নেব, তখন শুধুমাত্র একজন সিনিয়র কর্মী হিসেবে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হবে। বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জার।

তবে বস্তুত আমরা বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গিয়ে হাসিমুখে সব বরণ করে নিই; কারণ নেতৃত্বের চেয়ে আমাদের জীবনের মূল্য অনেক। যদিও অভিযোগগুলো মানতে নারাজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। 

তাদের দাবি, করোনার কারণে শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই চিত্র। আমরা বর্তমানে অনুষদ কমিটি দিচ্ছি। ক্রমান্বয়ে সব কমিটি নবায়ন করা হবে। 

তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৬ মে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রথম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইলিয়াস হোসেন সবুজকে সভাপতি ও গণিত বিভাগের ৫ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম মাজেদকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বছরের জন্য ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেয়। 

একই বছরের ২২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়। সে হিসেবে এই কমিটির মেয়াদ ফুরিয়েছে ২০১৮ সালেই। তবে সাড়ে চার বছর পার হলেও বিলুপ্ত হয়নি বর্তমান কমিটি কিংবা অনুমোদন হয়নি নতুন কোনো কমিটির। মেয়াদোত্তীর্ণ ওই কমিটিতে থাকা অধিকাংশ নেতাই অছাত্র, চাকরিজীবী এবং বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেছেন। এদিকে দীর্ঘদিন নতুন কমিটি না থাকায় ক্ষুব্ধ পদপ্রত্যাশী  নেতাকর্মীরা। দীর্ঘদিন সম্মেলন ও নতুন কমিটি না হওয়ায় রাজনীতি ত্যাগ করছেন কেউ কেউ। 

অথচ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনূর্ধ্ব-২৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারেন। তবে সদস্যপদ ঠিক রাখার মূল শর্ত হলো শিক্ষাজীবন অব্যাহত থাকা। কিন্তু কুবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ প্রায় দুই ডজন নেতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। 

কিন্তু সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের ৫-এর ‘ক’ উপধারা অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবী কোনো ব্যক্তি ছাত্রলীগের সদস্যপদ রাখতে না পারলেও কুবি ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ওইসব নেতার কোনো পদত্যাগপত্র কিংবা স্থলাভিষিক্ত নতুন নেতাকে কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদরা। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমান কমিটিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অধিকাংশ নেতা অছাত্র, চাকরিজীবী ও বিবাহিত। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ম ব্যাচ শিক্ষাকার্যক্রম চুকিয়ে বের হয়ে গেলেও বর্তমান সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ ব্যাচের ছাত্রই রয়েছেন। বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে নামকাওয়াস্তে ছাত্রত্ব ধরে রেখেছেন সভাপতি। যার ফলে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে না নতুন নেতৃত্ব, অন্যদিকে বছরের পর বছর একই কমিটির কার্যক্রম পরিচালনায় হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন উদীয়মান নেতাকর্মীরা।

তবে নেতৃত্বসংকট নেই দাবি করে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ বলেন, প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব নবায়ন করে চলমান রাখে। আর আমাদের কোনো নেতৃত্বসংকট হচ্ছে না। 

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী এক নেতা বলেন, বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মীদের মাঝে কোনো আশা নেই। কারণ, বছরের পর বছর ছাত্রত্বহীন নেতারা সভাপতি-সম্পাদক হয়ে আছেন। আমি এখন এ বিষয়ে কথা বলছি, এটা যদি কেউ জানতে পারে, তাহলে আমি হয়তো এ ক্যাম্পাসে আর আসতে পারবো না। বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। সভাপতি-সম্পাদকের বিষয়ে কেউ কথা বললে হয় সে শিবির হবে, নয়তো সে ছাত্রদল হয়ে যাবে। এর আগে যারাই কথা বলেছে, তারা এখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, গ্রুপিংয়ের রাজনীতির জেরে ইতোমধ্যে পদপ্রত্যাশী প্রতিপক্ষের ডজনখানেক নেতাকর্মীকে মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার ঘটনা ঘটেছে। তারা বর্তমান সভাপতি-সম্পাদক সমর্থিত নেতাকর্মীদের দাপটে স্বাচ্ছন্দ্যে ক্যাম্পাসে আসতে পারেন না। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন নাবিল, ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও জয়নাল আহমেদকে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের কক্ষে ডেকে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন করা হয়। 

শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদের কক্ষে (৩০১) শিবির-ছাত্রদল নিধন নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়। এমনকি তাদের সঙ্গে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে সে সময়। তার কক্ষেই ২০১৭ সালের ৫ জুন মামুন চৌধুরী (গণিত, ৭ম ব্যাচ) ও পরিসংখ্যান ৮ম ব্যাচের এক শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে শিবির আখ্যা দিয়ে মারধর করা হয়। 

এছাড়াও গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মমিন শুভ নামের প্রতিপক্ষ গ্রুপের এক কর্মীকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বেধড়ক মারধর করে হল থেকে বের করে দেয় ক্ষমতাসীন গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ বছরের ২ মার্চ পূর্বঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের একাদশ আবর্তনের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী সোহেল হাওলাদারকে বেধড়ক মারধর করে বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সমর্থিত নেতাকর্মীরা। 

এদিকে বর্তমান কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নিয়মিত কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অনুপস্থিতির। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন টেন্ডার এবং চাঁদাবাজিতে মত্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে চরম শূন্যতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি লোকপ্রশাসন বিভাগের ৬ষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থী এসএম শাহাদাত রহমান তারেক চাকরিতে যোগদান করেছেন দায়িত্ব পাবার পরই।

একই বিভাগের ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ ওয়াহিদ থাকলেও ২০১৮ সালেই শেষ হয়েছে তার ছাত্রত্ব। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সৌরভ চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হলত্যাগ করেছেন ২০১৯ সালে। একই চিত্র কাজী নজরুল ইসলাম হলেও। 

অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হলে আজ পর্যন্ত দেয়া হয়নি কোনো কমিটি। বঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান সভাপতির সাংগঠনিক কার্যক্রমের চেয়ে অর্থলিপ্সু মনোভাবের কারণে এমন ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমনকি এসব বিষয়ে যারা মতপ্রকাশ করেছেন, ইতিপূর্বে তাদেরকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বহুবার। শারীরিক আঘাতের ঘটনা ঘটছে অহরহ, যা বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সুকৌশলে সেটিকে ধামাচাপা দেয়া হয়ে আসছে।

সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন টেন্ডারের পেপার জমা দেয়ার দিনে ছাত্রলীগকর্মীদের পাহারায় নির্দিষ্ট ঠিকাদারের বাইরে কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবগত হলেও অদৃশ্য কারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কখনও। 

অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজে সর্বত্র একক প্রভাব বিস্তার করেন বর্তমান সভাপতি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে ছাত্রলীগের পদধারী বিভিন্ন নেতাকে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ নখদর্পণে রাখেন তিনি। ফলে অন্যান্য কর্মকর্তা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হন। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো নীতি বাস্তবায়নে মতামত দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন এই নেতা। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, করোনার কারণে শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই চিত্র। আমরা বর্তমানে অনুষদ কমিটি দিচ্ছি। ক্রমান্বয়ে সব কমিটি নবায়ন করা হবে। প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের মারধরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা তাদের অপকর্মের কারণে ছাত্রলীগ থেকে বিচ্ছিন্ন। 

টেন্ডারবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব টেন্ডার বর্তমানে অনলাইনে হয়ে থাকে। আর দু-একটি সশরীরে গ্রহণ করা হয়। এসবে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই।

অছাত্র, চাকরিজীবী ও বিবাহিতদের কমিটিতে না রাখতে কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও।
 
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। এ জন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাথে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তরুণ ও নতুন নেতৃত্ব তুলে আনা হবে। 

তিনি আরও বলেন, যেহেতু কমিটি অনেক আগে গঠন করা হয়েছে এবং মেয়াদোত্তীর্ণও হয়ে গেছে, তাই অনেকে বিয়েও করে ফেলতে পারেন। সে বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।