Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

যেভাবে বিসিএস ক্যাডার হলেন খাইরুল ইসলাম

নভেম্বর ১৯, ২০২১, ০৬:০৫ পিএম


যেভাবে বিসিএস ক্যাডার হলেন খাইরুল ইসলাম

মো. খাইরুল ইসলাম! হার না মানা এক যোদ্ধার নাম। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ৩৬তম বিসিএসে জায়গা করে নিয়েছেন বিসিএস প্রশাসনে। বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত রংপুরের পীরগঞ্জে।  সমপ্রতি তিনি কথা বলেছেন দৈনিক আমার সংবাদের সাথে।  শুনিয়েছেন পড়াশোনা, পরিকল্পনা, হতাশা আর সফলতার গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমার সংবাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক—  

আমার সংবাদ : বেড়ে ওঠার গল্প দিয়েই শুরু করতে চাই। 
খাইরুল ইসলাম : বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে এক প্রত্যন্ত জনপদে আমার বেড়ে ওঠা। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীভাঙনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা এ জনপদের মানুষকে বদলে দিয়েছে অসম্ভবভাবে। শিখিয়েছে টিকে থাকার লড়াই। এই জনপদের মাটি ও মানুষের সাথেই কেটেছে আমার শৈশব। দুরন্ত শৈশব।  

আমার সংবাদ : এত চাকরি থাকতে সিভিল সার্ভিসে কেন এলেন?  
খাইরুল ইসলাম : আমি ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। গ্রামের সেই ছোট স্কুল থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমার মনে হয়, এ দেশ এই জাতির ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে অধিক আয়ের জন্য বেসরকারি চাকরি করাটা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতা। সমাজের প্রতি এবং জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই সিভিল সার্ভিসে আসা। এ দেশ আমায় দিয়েছে অজস্র। আমারও দায়িত্ব আছে দেশের জন্য কিছু করা, মানুষের জন্য কিছু করা। গণমানুষের জন্য নিজের মেধা, ঘাম, রক্ত, অশ্রু দিয়ে কাজ করে যাওয়া পবিত্র দায়িত্ব। দেশের জন্য শ্রম দেয়ার মাঝেই এই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার এক সুযোগ। চমৎকার এক সুযোগ! 

আমার সংবাদ : বিসিএস নামক এই যুদ্ধে অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ ভালো দিকনির্দেশনার অভাবে ঝরে পড়েন। বিসিএসে কোন বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?  

খাইরুল ইসলাম : বিসিএস পরীক্ষায় কিছু কিছু অংশে গণিতের মতো নম্বর পাওয়া সম্ভব। আমি যেহেতু গণিতের শিক্ষার্থী ছিলাম সেহেতু গণিত আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সহজ ছিলো। পরীক্ষায় ভালো নম্বর তুলতে ইংরেজি ও বাংলা গ্রামার অংশ থেকে যথার্থ উত্তর করতে পারলে গণিতের মতো মার্কস আসে। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিষয়াবলির সংবিধান অংশ এবং বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদেও ভালো নম্বর পাওয়া যায় সহজেই। পাশাপাশি মানসিক দক্ষতা এবং গণিতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া চাই।  

আমার সংবাদ : প্রস্তুতির শুরুতেই কোন বইগুলো সংগ্রহে রাখা জরুরি বলে মনে করেন? 
খাইরুল ইসলাম : শুরু থেকেই নবম- দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ, সাধারণ বিজ্ঞান ও সাধারণ গণিত বইগুলো অবশ্যই চর্চায় রাখতে হবে। তা ছাড়া পরবর্তীতে বাজার থেকে ভালো এক সেট বই আপনার প্রস্তুতিকে আরও শানিত করতে সাহায্য করবে। 

আমার সংবাদ : অনেকেই কোচিং করাটাকে জরুরি মনে করেন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি? 
খাইরুল ইসলাম : বিসিএস যুদ্ধে যারা একদমই নতুন তাদের জন্য কোচিং সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাশে থাকে সবসময়। তা ছাড়া কোচিং আপনাকে নিয়মানুবর্তিতা শেখাবে, টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখাবে। অনেক শিক্ষার্থীদের মাঝে থেকে নমুনা পরীক্ষায় নিজেকে যাচাই করাটাও সহজ হয়। তা ছাড়া সকলের মাঝে এক প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা আর এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতি আপনার ভেতরে আগুনের প্রবাহকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দেবে। তবে কোচিং যে অবশ্যই করতে হবে তা কিন্তু নয়। আমার দেখা অনেকেই আছেন কোচিং ছাড়াই নিজেকে প্রমাণ করেছেন পৃথিবীর কাছে। ইচ্ছা আর লেগে থাকার মানসিকতা থাকলে বাজার থেকে ভালো মানের বই কিনে নমুনা পরীক্ষা দিয়ে নিজের প্রস্তুতির পরিধিকে জানতে পারবেন সহজেই।  

আমার সংবাদ : যুদ্ধক্ষেত্রে হতাশা আর আলো এক অনিবার্য সমীকরণ। জীবনের এই গল্পে হতাশ হয়েছেন নিশ্চয়ই। হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সেই গল্প শুনতে চাই। 
খাইরুল ইসলাম :  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আমি পছন্দের বিষয়ে এডমিশন নিতে পারিনি। শুধু আমি নই, এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের সাথে। প্রথম থেকেই গণিত আমার ভালো লাগেনি। গণিতের সাথে কোথায় যেন এক বৈরী সম্পর্ক। কোথায় যেন মনোযোগের সেই সুতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। প্রাপ্ত বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা না থাকায় ভর করেছিল হতাশা আর বিড়ম্বনা। প্রথমদিকে গণিতে ফলাফলও আশানুরূপ হয়নি।  তবুও থেমে যাইনি। পরিস্থিতির সাথে নিজেকে সামলে নিতে শিখেছি। আমি প্রথমবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলাম।  বিষয় পছন্দ না হওয়ার পরও এক বছর সময় নষ্ট করে পরবর্তীতে মাইগ্রেশন বা পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নিজের মনের মতো বিষয়ে ভর্তি হওয়াটাও আমার এবং আমার পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিলো। অবশেষে গণিতকেই ভালোবেসে ফেলি। সেই থেকে গণিতের সাথেই সন্ধি; মানিয়ে নেয়ার এক নতুন গল্প। 

আমার সংবাদ : পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? কার কথা বেশি মনে পড়ছে?  
খাইরুল ইসলাম :  অনুপ্রেরণা বলতে আমার পরিবারকেই বুঝি। সুখে-অসুখে তারাই পাশে থেকেছে। সাহস জুগিয়েছে আমার হতাশা আর অসময়ে। আসলে তারা পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমার বড় ভাইকে খুব মনে পড়ছে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি কলেজের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জীবন যখন বোঝা হয়ে চেপে ধরেছে তখনো নীরবে পাশে ছিলেন ভাইয়া। ভেঙে যাওয়ার গল্প আর হতাশা থেকেই দেখিয়েছেন আলো। অনন্তর আলো। এ ছাড়া আমার বড় বোন এবং বাবা-মায়ের দোয়া- সহযোগিতা ছাড়া খাইরুল ইসলাম থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খাইরুল ইসলাম হয়ে ওঠার গল্পটা বেশি কঠিন ছিলো!

আমার সংবাদ : আজকাল বিসিএস এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিসিএস কি একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত? কি মনে করেন? 
খাইরুল ইসলাম :  বিসিএস না হলেই জীবন বৃথা যাবে এমনটা ভাবা ভুল। তবে সমাজে বিসিএস নিয়ে নিশ্চিত এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনিই সমস্যা,  তাহলে আপনি চাইলে নিজেকে পাল্টাতে পারবেন। জীবন থেকে শিখতে পারবেন—  উপভোগ করতে পারবেন। বেশির ভাগ লোকই চায় পৃথিবীর আর সবটাই পাল্টে যাক। তারা নিজেরা বদলাতে চায় না। অন্যদের চেয়ে নিজেকে পরিবর্তন করাটা সহজ এবং আপনার জন্য নিশ্চয়ই তা কমফোর্ট জোন হবে। আসলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। তা ছাড়া  অনেকে বেসরকারি চাকরি করেও জাতির কাছে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। তাদের বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা কিন্তু কম নয়। জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই, এগুলো নিয়েই জীবন। মোট কথা, শুধুই বিসিএস এবং অন্ধভাবে বিসিএস আপনার জীবনকে বিকেন্দ্রীকরণ আর হতাশায় ঠেলে দিতে পারে।

আমার সংবাদ : বিসিএসে অর্থনৈতিক সংকট বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কি?  
খাইরুল ইসলাম :  অর্থনৈতিক সংকট বাস্তবে অনেক বড় একটি বিষয়। একটু সুযোগের অভাবে চোখের সামনে অনেক সম্ভবনাময় তরুণকে ঝরে যেতে দেখেছি। আমি জীবন থেকেই আপনাকে বলছি। তবে হার না মানার মানসিকতা আর কঠোর অধ্যবসায় থাকলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পরিমিত চেষ্টার পর সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চান। শুরু হবে নতুন কিছু; বদলে যাবে প্রেক্ষাপট। 

আমার সংবাদ : নতুনদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?  
খাইরুল ইসলাম : নতুনদের জন্য আমি তিনটি কথা বলতে চাই— পড়ুন, পড়ুন এবং  পড়ুন। নিজেকে প্রস্তুত করুন সেরাটা দিয়ে। সাফল্য ধরা দেবেই ইনশাআল্লাহ। 

আমার সংবাদ : আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। 
খাইরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ। আমার সংবাদের জন্য শুভকামনা।