Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়ছে জটিলতা

নভেম্বর ২১, ২০২১, ০৬:২০ পিএম


শিক্ষাব্যবস্থায় বাড়ছে জটিলতা
  • ঘনিষ্ঠজনের চেয়েও প্রিয় হয়ে উঠছে স্মার্টফোন আসক্তি 
  • বইয়ের পরিবর্তে বাড়ছে স্মার্টফোন নির্ভরতা 
  • হ্রাস পাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা: অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল 
  • কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করা জরুরি: অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস

করোনা ভাইরাস! পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর সব মহামারির মাঝে অন্যতম। এ ভাইরাস যেনো সভ্যতা আর উন্নত সব প্রযুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সারা দুনিয়ায় নিজের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করেছে। দুনিয়া কাঁপানো মহামারির মাঝে ব্ল্যাক ডেথ, কলেরা মহামারি, এশিয়ান ফ্লু , এমনকি স্প্যানিশ ফ্লুকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি শিক্ষা খাতেও এর একটি ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শেষে সশরীরে ক্লাসে ফিরতে শুরু করছে শিক্ষার্থীরা। সশরীরে ক্লাসে ফিরলেও করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বাড়ছে জটিলতা-অনিশ্চয়তা। প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠ্যকার্যক্রম পরিচালনায় আসছে পরিবর্তন। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা আর হাতে-কলমের এই শিক্ষার মাঝে যেনো আবার নতুন করেই পরিচিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। 

অনলাইনে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষাকার্যক্রম চালু রাখলেও পর্দার আড়ালেই ঝরে গেছে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। দীর্ঘ এই যুদ্ধে যারা টিকে আছেন তাদেরও পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীদের মাঝেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে।

করোনা কাইরাস মহামারিকালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের ওপর করা করোনা প্রভাব শীর্ষক ব্র্যাকের এক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে গৃহস্থালির কাজ ও পরিবারকে সহযোগিতা করতে হচ্ছে। সেই সাথে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারে খাদ্য সংকট রয়েছে। 

অন্যদিকে যাদের পরিবারে খাদ্য সংকট ছিলো না এবং কোনোরকম আয় বর্ধক কাজ করতে হয়নি সেসব পরিবারের প্রায় ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গল্প-গুজব বা আড্ডাবাজি করে দিন অতিবাহিত করছে। এ ছাড়া বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক নির্দেশনা না পাওয়ায় ৪৪ শতাংশ, পরিবার থেকে সাহায্য না পাওয়ায় ১৯ শতাংশ এবং ঘরে পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ১১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। 

সেভ দা সিলড্রেনের একটি আলোচনায় উঠে এসেছে, করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে হয়তো স্কুলেই যাওয়া হবে না প্রায় এক কোটি শিশুর। করোনার ভয়ানক থাবা শেষ হলেও শিক্ষার ওপর পড়বে ক্ষতিকর প্রভাব। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা মহামারির পর আগামী কারিকুলাম গতানুগতিক হবে না। বর্তমান সময় ও আগামীর কথা মাথায় রেখেই কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করা জরুরি। বর্তমানে কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলাম প্রয়োজন বলেও মনে করছেন অনেক শিক্ষাবিদ। 

শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুধু নয়, আরও অনেক কিছু জড়িত। অনেকেই টিউশনি করে, কেউবা খণ্ডকালীন চাকরি । শুধু নিজেদের খরচই নয়, এই ক্ষুদ্র টিউশনির টাকা থেকে কেউবা মা-বাবার ওষুধের খরচ দিত, কেউবা হয়তো দিত ছোট ভাইবোনের পড়ার খরচ। করোনাকালে তার ভয় শুধু করোনা আক্রমণের নয়, আরও বিস্তৃত। এই করোনার থাবায় সে বেঁচে গেলেও কীভাবে লড়বে আবার বেঁচে থাকা জীবনে? এ নিয়েও বাড়ছে সংশয়। ফলে অনেকে বাধ্য হয়েই পড়াশোনা ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অনিশ্চয়তার দেশে। যে সকল শিক্ষার্থীরা অনলাইনেই তাদের সেমিস্টার শেষ করেছেন কিন্তু করোনা পরবর্তী এই সময়ে সশরীরে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছেন তাদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাজেদ আলী আমার সংবাদকে বলেন, অনলাইন ছিলো আমাদের কাছে স্বপ্নের মতোই একটি বিষয়। এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো অনলাইনে শেষ করলেও শিক্ষার্থীরা ১০ শতাংশও বুঝতে পারেননি। কোনোরকম রিভিউ ক্লাস না দিয়েই সরাসরি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে কোনোরকম ক্লাসে অংশগ্রহণ না করেই পরীক্ষা দিচ্ছেন। এ ছাড়া একই সাথে একাধিক পরীক্ষার এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ ডিপ্রেশনে ভুগছেন। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দীর্ঘদিন অনলাইনে ক্লাস করাতে অনেকটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছি। তা ছাড়া দীর্ঘদিন বই ছাড়াই পড়াশোনা করায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বই না নিয়ে মোবাইল ফোনের ওপরই নির্ভর করছে। আমাদের কিছু সেমিস্টার অনলাইনে শেষ হলেও পরীক্ষা দিতে হচ্ছে অফলাইনে। ফলে বাড়ছে পরীক্ষাভীতি। পাশাপাশি নতুন করে সব কিছু শুরু করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আবাসন সংকট এবং টিউশনি না পাওয়াতে নিম্নবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী ঢাকায় ফিরতে পারছেন না।’ 

করোনা পরবর্তী শিক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বড়নাল দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক সৈয়দ হোসেন আলী আমার সংবাদকে জানান, এখন শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছুটা আচরণগত পরিবর্তন বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘদিন অনলাইন ক্লাস করার প্রভাবে শ্রেণিকক্ষেও বেড়েছে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাত্রা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মনোযোগের ক্ষমতাও কিছুটা বাহ্যত হয়েছে বলে জানান এ শিক্ষক। 

করোনা পরবর্তী শিক্ষা জটিলতা নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান আসিফ ইকবাল আরিফ বলেন, ‘দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে ভার্চুয়াল ভাইরাসের প্রভাব। ফলে শিক্ষার্থীদের স্মৃতিশক্তি লোপ এবং মনোযোগ দেয়ার সক্ষমতা হারাচ্ছে। 

সমপ্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইন্ড ব্রেন বিহেভিয়ার সায়েন্স অব হ্যাপিনেস ও টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা মটোরোলার যৌথ উদ্যোগে একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশ ভারতীয় তরুণদের কাছে প্রিয়জন বা ঘনিষ্ঠজনের চেয়েও প্রিয় হলো তাদের স্মার্টফোনটি! এমনকি এটি সাথে না থাকলে বা হারিয়ে ফেলার ভয়ে প্রায়ই তারা ভীষণ অস্থিরতা-আতঙ্কে ভোগেন। এতে আরো বলা হয়, স্মার্টফোন-আসক্তরা ক্রমশ জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। তবে আশা করছি, খুব শিগগিরই সরাসরি ক্লাসের প্রভাবে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো।’ 

এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘করোনা পরবর্তী শিক্ষায় কিছুটা পরিবর্তন জরুরি। বিশেষ করে সিলেবাসের পরিবর্তন বা সংক্ষেপ করাটা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার পরেও এই সময়ে একের পর এক পরীক্ষাটা আসলেই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা একটা সমাজ বিছিন্ন অবস্থায় থাকার প্রভাবে বেড়েছে আচরণগত পরিবর্তন এবং হতাশা। পর্দার আড়ালে একটা প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে। তবে আশার কথা হলো, সহ-শিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা শিগগিরই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। 

করোনা পরবর্তী শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তন আসতে পারে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মাঝে আচরণগত বিভিন্ন পরিবর্তন আসতে পারে। সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে, অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা গিয়ে অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার, ভার্চুয়াল গেম, ফেসবুকিং এবং বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করায় আসক্ত হয়ে পড়ায়। শিক্ষার চলমান প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত না থাকায় তাদের (মোটিভেশনাল ফোর্স) বিভিন্ন দিকে কনভার্ট হয়েছে, বেড়েছে আসক্তি।

এ আসক্তির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক চিন্তা এবং না পারার ভয় কাজ করছে। ফলে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ স্বাভাবিক জীবনের বাইরে চলে যাচ্ছে। কাজ শুরুর আগের এমন ভয় এবং আতঙ্ক এক ধরনের মানসিক রোগ। তবে শিক্ষার্থীদের (কোপিং ক্যাপাবিলিটি) বা পরিস্থিতি  মোকাবিলা করার ক্ষমতা আসতে কিছুটা সময় নিতে পারে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংও প্রয়োজন হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিচর্যা এবং সহযোগিতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।