Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

দুই পক্ষের আইনি মতভেদ

নভেম্বর ২৩, ২০২১, ০৭:২০ পিএম


 দুই পক্ষের আইনি মতভেদ

গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দরকার উন্নত চিকিৎসা। দল ও পরিবারের পক্ষ থেকেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। তবে আইনি গ্যাড়াকলে পড়ে সহসা সেই সুযোগ মিলছে না। নানা শর্তেই আটকে আছে বেগম জিয়ার বিদেশযাত্রা। এদিকে আইনি ব্যাখ্যা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁআশা। সরকার পক্ষ বলছে, আইনগতভাবে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। 

অপরদিকে বিএনপি বলছে, আইনে বিদেশযাত্রার সুযোগ আছে, তবে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই আটকে রেখেছে। এ অবস্থায় আইনজ্ঞরাও নানা মতামত তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ভিন্নতা। কেউ বলছেন সুযোগ রয়েছে, আবার কেউ বলছেন আইনে সুযোগ নেই। তবে সামগ্রিকভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে সরকারের অনুমতি দেয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলেন, যে শর্তে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছে, সেটি পরিবর্তন করা যেতে পারে। মুমূর্ষু পরিস্থিতি হলে মানবিক বিষয়ে আইন দরকার হয় না। অবশ্য সরকারপক্ষের আইনজীবীদের মতে, আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

জানা গেছে, আবেদন বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যানের পরও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে গত বৃহস্পতিবার তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার আবারো আবেদন করেন। 

এ বিষয়ে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিএনপিদলীয় নারী সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে খালেদা জিয়ার আবেদন নতুন করে বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। 

তাকে আবার জেলে গিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আবেদন করলে তা বিবেচনা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ও দণ্ডাদেশ স্থগিত করে যে দুটি শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছিল, তা শিথিল করে এখন তাকে বিদেশে যেতে দেয়ার ‘সুযোগ নেই’।

অবশ্য বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মতে, আইন দিয়ে সব কিছু বিবেচনা করা যায় না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বয়স, অসুস্থতা ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা করে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের দাবি, আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এটি করা হচ্ছে। সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা মওকুফ বা সাজা কমাতে পারে। 

একই সাথে উদাহরণ টেনে তারা বলেন, এর আগে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব কারাগারে থাকাবস্থায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ আছে।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কীভাবে বিদেশে যাবেন। তিনি (খালেদা জিয়া) তো দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে তার সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার এবং হাসপাতালে চিকিৎসার সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিদেশে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বা আইনেরও বিধান নেই। তার মতে, চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড যদি সরকারের কাছে সুপারিশ করে সেটা হয়তো পরিস্থিতি ও মানবিক কারণে বিবেচনা করতে পারে।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘এখানে সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সরকার যদি চায় তবে বেগম জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন। দণ্ডবিধির ৪০১ আলোকে সরকার যেমন কিছু শর্ত দিয়েছে তেমনি তারা চাইলে প্রয়োজনে এই শর্ত শিথিল করে বা সংশোধন করে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে পারে। মানবিক দিক বিবেচনা করে সবকিছু করা সম্ভব।’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(৬) অনুযায়ী, সরকার অবশ্যই অনুমতি দিতে পারবে। মানবিক বিবেচনার একটি বিষয় থাকে, অতিতে অনেকে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেছেন। এর জন্য আলাদাভাবে আদালতের অনুমতি প্রয়োজন নেই।’ 

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় বলা আছে, সরকার কোনো শর্ত ছাড়া অথবা শর্তসাপেক্ষে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা স্থগিত করতে পারে। এখানে খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা করার— এই দুই শর্ত দিয়েছিল। প্রথম শর্তটি সরকার বারবার পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ, ছয় মাসের শর্তটি সরকার ইতোমধ্যে তিনবার পরিবর্তন করেছে। যাতে খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তির মেয়াদটি পুনরায় ছয় মাস করে বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথম শর্তটি যদি পরিবর্তন করা যায়, তাহলে দ্বিতীয় শর্ত কেন পরিবর্তন করা যাবে না।’ তার মতে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। 

তিনি আরও বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা নিয়ে আইনমন্ত্রী সংসদে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার সাথে আমি একমত নই। কোনো শর্ত বদলানো বা পরিবর্তন করা যাবে না, এটা মোটেও সঠিক আইনি ব্যাখ্যা নয়। শর্ত পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকারের আছে।’

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘সরকার ইচ্ছা করে খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে চিকৎসার সুযোগ দিচ্ছে না। এটি অমানবিক। তাকে দণ্ডবিধির যে ৪০১ ধারায় নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত রেখে সাময়িক মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেই ধারায়ই সরকার চাইলে তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সুযোগ দিতে পারে। ওই আইনে শর্তসাপেক্ষে বা শর্তহীন মুক্তি দেয়া যায়। দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা যায়। সরকার রাজনৈতিক কারণে সেটা করছে না।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘দুদকের মামলায় সরকারের হস্তক্ষেপ করার আইনগত কোনো এখতিয়ার নেই। খালেদা জিয়ার যে আবেদনই থাকুক না কেন, তাকে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে যেতে হবে। 

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আইন খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছে। সেই সাজা মওকুফের এখতিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রপতির। এখানে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে না। সাময়িক মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য যে সুযোগটা সরকার দিয়েছে তা অনেক বেশি।’