Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রযুক্তি মাফিয়াতে বাড়ছে হতাশা

নভেম্বর ২৩, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


প্রযুক্তি মাফিয়াতে বাড়ছে হতাশা
  • টেক কোম্পানিগুলো আয় করছে বিলিয়ন ডলার
  • ইন্টারনেটের লাগামহীন ব্যবহার মাদকের চেয়েও বেশি ভয়াবহ —গবেষণা
  • প্রযুক্তিপণ্যের অতিরিক্ত ব্যবহারে বাড়ছে আত্মহত্যা 
  • প্রযুক্তি মাফিয়ারা রয়ে গেছে স্রোতের বিপরীতেই
  • ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত: আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

পৃথিবীর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের প্রায় ২৭০ কোটিরও অধিক মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এর একটি ব্যাপক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজে। 

যোগাযোগের সহজীকরণ এবং হাতের কাছেই পরিচিতি-অপরিচিত মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়া, পছন্দ অপছন্দের সাথে মতামত জানানোর সুযোগ থাকায় আমাদের প্রতিদিনের রুটিনে এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আপনি জানেন কি আপনার শরীর, মন এমনকি জীবনের ওপরও পড়ছে এর প্রভাব! 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক, টুইটার, ওয়েব সিরিজ, অনলাইন গেম, এমনকি সেলফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে টেক কোম্পানিগুলো বিলিয়ন ডলার আয় করলেও সর্বনাশ হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। বাক্তিগত জীবন, মনোদৈহিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক শান্তির জন্য এক ভয়ানক হুমকি হয়ে উঠতে যাচ্ছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। 

গবেষকদের মতে, ফেসবুক মাদকের মতোই এক নেশা। স্মার্টফোন- ইন্টারনেটের লাগামহীন ব্যবহার আর অনলাইন গেম-ইউটিউব- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি জীবনঘাতী মাদকের চেয়েও বেশি মারাত্মক। অনলাইন নির্ভর এমন আসক্তিকে গবেষকরা ‘ডিজিটাল কোকেন’ নাম দিয়েছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকের চাহিদা সৃষ্টি হলে মাদকাসক্ত ব্যক্তির স্নায়ুতে যে রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, ঠিক একই ঘটনা ঘটে এসব প্রযুক্তিপণ্য আসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কেও। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য হলো, ২০১০ সাল থেকেই ১৩-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ও প্রযুক্তি পণ্যের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বিষণ্নতায় ভোগা ও আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে গেছে।

পরবর্তী পাঁচ বছরে যা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬৫ ভাগে। যেসব কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিভাইসে দিনে পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় কাটাচ্ছেন তাদের ৪৮ ভাগ অন্তত একবার হলেও আত্মহত্যার  চেষ্টা করেছেন। 

২০১৬ সালের ইউনিসেফ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ইউজারের একজনই শিশু। যে সব শিক্ষার্থী অনলাইন গেমে আসক্ত তাদের কাছে গেমের জগতটাই বাস্তব, এখানকার সবকিছুই সে নিয়ন্ত্রণ করছে। গেমে আসক্ত ব্যক্তি বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়া অনলাইনে অশালীন কথা ও ছবি, অকথ্য গালিগালাজ বা সাইবার বুলিং থেকে হত্যার হুমকির মতো ঘটনাও ঘটছে। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দুনিয়াব্যাপী ফেসবুক, ইউটিউব বা ভার্চুয়াল গেমের স্রোত চললেও প্রযুক্তি মাফিয়ারা কিন্তু স্রোতের বিপরীতেই রয়ে গেছেন। কোটি কোটি শিশু-কিশোর তরুণের মস্তিষ্কের চূড়ান্ত সর্বনাশ করলেও প্রযুক্তি উদ্ভাবকরা ঠিকই আগলে রাখেন নিজ সন্তানদের। অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস কখনো তার সন্তানদের আইপড ব্যবহার করতে দেননি। ফেসবুকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট চামাথ পালিহাপিতিয়া সাত বছর ফেসবুক বাবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোর দায়িত্বে থাকলেও নিজে ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তিনি এ-ও বলেছেন, (My kids are not allowed to use that shit)।  

শুধু কি তাই? ফেসবুকের পোস্ট বা ছবিতে লাইক পাওয়ার জন্য মানুষ কত উদ্ভট কাজ করে, অথচ এই লাইকের উদ্ভাবক জাস্টিন রোজেস্টাইন নিজের ফোন থেকে সযত্নে লাইক বাটনটি সরিয়ে দিয়েছেন আসক্ত হওয়ার ভয়ে। শুধু তা-ই নয়। ফেসবুক-টুইটারের শীর্ষ নির্বাহীরা কেউই আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করেন না। কালেভদ্রে স্ট্যাটাস দেন বা টুইট করেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ তো আরও বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দেখভালের দায়িত্বে আছে ১২ জন সহকারী। অর্থাৎ সিলিকন ভ্যালির হর্তাকর্তারা ও তাদের সন্তানরা প্রযুক্তিপণ্য-সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপস থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশে শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা একটি সমস্যা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তা হচ্ছে ক্লাসরুমেও ছাত্রছাত্রীরা মোবাইলে মেসেজ চালাচালি করছে। টিফিন বিরতিতেও নেই খেলাধুলায় আগ্রহ। আসক্তদের মতোই তারা ডুবে থাকছে ভার্চুয়াল জগতে। বন্ধু বা পরিচতজন পাশে বসে থাকলেও তাদের মস্তিষ্ক কাজ করছে তথাকথিত এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধমেই।

প্রযুক্তি ব্যবহারের এমন আসক্তির অভিজ্ঞতা জানিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেদওয়ানুল শিপলু জানান, সামাজিকতা রক্ষার নামে আমি সারাদিন ফেসবুকিং করতাম। এটা কিভাবে একজন সামাজিক মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, সেটা আমি বুঝতাম না। ফলে দিনের পর দিন আসক্ত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পরপর  ফেসবুকে নতুন কিছু এলো কিনা অথবা কেউ লাইক-কমেন্ট করলো কিনা এমন মানসিক সমস্যার শিকার হয়েছি। তবে ফেসবুকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এখন সংকটকে শক্তিতে রূপ দিতে পেরেছি।    

অনলাইন নির্ভর এমন আসক্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মাদকাসক্তরা সাধারণত দিনের একটি বিশেষ সময়ে মাদক গ্রহণ করে। কিন্তু স্মার্টফোন ইন্টারনেট-ফেসবুক আসক্তি ২৪ ঘণ্টাই মাথার মধ্য ঘুরতে থাকে। এতে আসক্তরা কর্মক্ষেত্র, খাবার টেবিল, এমনকি  টয়লেটে গিয়েও স্মার্টফোন চালাতে থাকে।’ 

অনলাইন এই আসক্তি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারেক মাহমুদ হোসেন জানান, ‘ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রযুক্তির একটা স্বচ্ছ এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি স্কুল, কলেজ এবং  ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে পৃথক কাউন্সিলিং সেন্টার। কিন্তু বাংলাদেশে সে সুযোগ না থাকায় পরিবারকেই দায়িত্ব নিয়ে স্মার্টফোন আসক্তি কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করে কাউন্সিলিং করাটা জরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিছুটা থাকতে পারলেও তা যেন প্রধান কিছু হয়ে না ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।’