Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ময়লার গাড়ি যেন যমদূত

নভেম্বর ২৪, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


 ময়লার গাড়ি যেন যমদূত

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। ময়লা পরিবহনের ক্ষেত্রে চালকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে এক উদাসীন সংস্থার নাম। এ সংস্থার উদাসীনতায় চালকরা যেন ময়লার গাড়ি নয়, নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্যাংকার নিয়ে। দেখে মনে হবে যেন ময়লাবাহী গাড়ি নয়, নগরীর সড়ক চষে বেড়াচ্ছে প্রাণঘাতী দানব। 

এসবের যারা চালক তারা মানুষকে পিষে মারছেন কীটপতঙ্গের মতো, আবার সড়কের অন্য যানবাহনকেও যানবাহনই মনে করেন না তারা। সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতায় চালকদের এরূপ বেপরোয়া ও উগ্র মনোভাবে সংস্থার গাড়িগুলো দিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। যার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না কোনো সংস্থার কাছে। তবে গত কয়েক বছরে রাজধানীতে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি চাপা ও ধাক্কায় বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে। রাজধানীতে প্রায়ই সংস্থার গাড়িচাপায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এদিকে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও এসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না ট্রাফিক বিভাগও। 

যদিও ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে, ব্যবস্থা নেয়াও হচ্ছে। এরই মধ্যে গতকাল নটরডেম কলেজের একাদশ বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়ি। 

হাফ পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের পটভূমিতেই সহপাঠীকে হারিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভে নেমেছে নটরডেমের শিক্ষার্থীরা। গতকাল তারা ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও দোষী চালকের ফাঁসির দাবি জানিয়েছে। বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে কয়েকশ শিক্ষার্থী। মতিঝিলের শাপলা চত্বর ও এর আশপাশের সড়ক অবরোধের পাশাপাশি নগর ভবনের সামনেও অবস্থান নেয় তারা। মতিঝিল থানার ডিউটি অফিসার এস আই কলিমউদ্দিন বলেন, দুর্ঘটনায় জড়িত গাড়ির চালককে আটক করা হয়েছে। 

পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, আমরা ঘটনাস্থল থেকে সংশ্লিষ্ট চালককে আটক করেছি। চালকের নাম রাসেল। মামলার প্রস্তুতি চলছে। গাড়িটিও জব্দ করা হয়েছে। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলিস্তান গোলচত্বরে হল মার্কেটের সামনে নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেয় গাড়িটি। এরপর ঢাকা মেডিকেলে নিলে দুপুরে চিকিৎসক তার মৃত্যুর খবর জানান। 

এদিকে এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের। তিনি জানান, ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর সিতওয়াত নাঈমকে আহ্বায়ক এবং মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমানকে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএসসিসি। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও গতকাল রাতে মেয়র ফজলে নূর তাপস নাঈম হাসানের জানাজায় অংশ নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

এর আগে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি গ্লোরিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের স্টাফ খালিদ (৫০)। ১৬ মে যাত্রাবাড়ীতে একই সংস্থার ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান মোস্তফা (৪০) নামের এক রিকশাচালক। আহত হন রিকশায় থাকা হরেন্দ্র দাস (৭০) নামের এক আরোহী। ওইদিন ঘটনার পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই মাসে শাহজাহানপুর টিটিপাড়ায়ও ট্রাকচাপায় স্বপন আহমেদ দিপু (৩৩) নামে এক ব্যাংক কর্মচারী নিহত হন। 

এর আগে ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মিরপুরেও ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন আবদুল খালেক হাওলাদার (৬৭) নামের এক ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা। আবদুল খালেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার আগের মাসে বংশালে নিহত হন নুরজাহান বেগম (২১) নামের এক গৃহবধূ। একই ঘটনায় আহত হন স্বামী মো. আসিফ উল্লাহও।

সবকটি দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণেই এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এর কারণ জানতে চেয়ে গতকালের ঘটনার পর থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাসের মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। একই ইস্যুতে সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক ফরিদ আহাম্মদের মুঠোফোনেও ফোন করলে তিনি রিসিভ করেই কেটে দেন। 

তবে ডিএসসিসি সূত্র বলছে, সিটি কর্পোরেশনের কোনো চালক দুর্ঘটনা ঘটালে তাকে সাথে সাথে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রতিটি ঘটনা তদন্তও করা হয়। চলতি বছরের সবকটি ঘটনার একটিতে চালক জেলে আছে। বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কার্যত বন্ধ করা যাচ্ছে না চালকদের বেপরোয়াপনা।

তথ্যানুযায়ী, ডিএসসিসিতে মোট যানবাহন সংখ্যা ৫১৩টি। এর মধ্যে ১৫০টি গাড়ি নিবন্ধিত। আর নগর সংস্থাটির নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৪৭। ২০০ গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। বাকি ১৬৬টি গাড়ি কিভাবে চলে তার সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। গাড়ির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে নিবন্ধন ছাড়াই সড়কে চলছে গাড়িগুলো। 

জানা গেছে, নিবন্ধিত চালক ছাড়া ডিএসসিসির বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। কখনো কখনো আবার ক্লিনারদেরও দেখা যায় চালকের ভূমিকায়। ফলে সংস্থার গাড়িগুলো দিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ডিএসসিসির ময়লার গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালানোর অভিযোগ বহু পুরনো। বারবার দুর্ঘটনা ঘটালেও প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়নি নগর সংস্থা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহযোগী অধ্যাপক শিফুন নেওয়াজ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অনেক গাড়ির হেডলাইট, ইন্ডিকেটর, রং দেখেই বুঝা যায় এর ফিটনেস নেই। এসব গাড়ির ত্রুটি থাকতেই পারে। এ থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেক চালক সরকারি গাড়ি চালাচ্ছে ভেবে অস্থির থাকে। এ কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এ ক্ষেত্রে চালককে রোড সেফটি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া গাড়ি কে চালাচ্ছে সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকা দরকার। অথচ এ-ও দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি চালাচ্ছে কিশোর। যার নেই লাইসেন্স কিংবা গাড়ি চালানোর কোনো অনুমতিপত্র। 

সূত্র বলছে, কাগজপত্র সবসময় অফিসেই থাকে। সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি দেখে কেউ চেক করে না। তাই কাগজপত্রেরও প্রয়োজন হয় না। তবে একাধিক সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনের অধীনে থাকা এসব গাড়ি কিংবা চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও সাধারণত তারা তা করেন না। 
ময়লার গাড়ি হিসেবে এতটা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না তারা। 

তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি হলেও এসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ট্রাফিক বিভাগের রয়েছে। কোনো রকম দায়বদ্ধতা নেই। প্রচলিত আইনের আওতায় আমরা ব্যবস্থা নিয়েও থাকি। নিয়মিত কাগজ তল্লাশি করা এবং কাগজ ঠিক না থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।