Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা চাচ্ছে কী

নভেম্বর ৩০, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা চাচ্ছে কী

চাকায় পিষ্ট করে হত্যা, ভাড়া, নিপীড়ন নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীরব ভূমিকায় যেনো সড়কের দানবে পরিণত হয়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। মালিকদের রোষানলে পড়ে শ্রমিকরা সড়কে পিষে মারছে যাত্রীদের, কাটছে পকেট। 

শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন-সংগ্রামেও কার্যত আসছে না সমাধান, কর্ণপাতই করছে না পরিবহন মালিকপক্ষ। বরং মালিকপক্ষ সরকারের সাথে বসে নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রবণতায় বেপরোয়া হয়ে উঠতেও বাধ্য করছে শ্রমিকদের। যে কারণে সড়কে বাড়ছে মৃত্যু। 

এছাড়াও গতকাল হাফ পাশের বিষয়েও দেয়া সিদ্ধান্তকে বৈষম্যের নতুন মাত্রা বলছে শিক্ষার্থীরা। যে কারণে এ সিদ্ধান্তকেও প্রত্যাখান করেছে তারা। সহপাঠীর মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার, নিরাপদ সড়ক, হাফ পাসসহ একাধিক দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা আন্দোলনেও কোনো একটি ইস্যুর কার্যকর সমাধান না পাওয়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা। 

অথচ এত কিছুর পরও এখন পর্যন্ত সরকার পক্ষের কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তের আশ্বাসও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে চলমান আন্দোলন আরও তীব্র হচ্ছে। তবুও সড়কে থামছে না শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনা। গত সপ্তাহে গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সড়কে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। 

নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই গত সোমবার রাতে গ্রিন অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের চাপায় রামপুরা বাজারের সামনে প্রাণ হারায় আরেক শিক্ষার্থী (এসএসসি পরীক্ষার্থী দুর্জয়)। ওই ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বেশকটি বাসে আগুন দেয়। 

আগের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সোমবার রাতের ঘটনা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও বেগবান করে। যে কারণে গতকাল মঙ্গলবার সকালেই তারা নেমেছে সড়কে। ‘ছাত্রসমাজ জেগেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, সড়কে হত্যাকারীদের বিচার চাই’ এমন স্লোগানে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের মতোই উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকার সড়ক। 

ক্লাস শেষে কিংবা ক্লাস না করেই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দখলে নিয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাস্তা অবরোধ করে তারা। রামপুরা এলাকায় একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন দুর্জয়ের মৃত্যুর ঘটনায় ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইম্পেরিয়াল কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল ও রাজধানী আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রগতি সরণিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।  তারা রামপুরা ব্রিজ এলাকায় সড়কে বসে পড়ে। এতে সড়কের দুইপাশে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের সাথে কথা বলে যাদের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে তাদের ছেড়ে দেয়। 

রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম  বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে রয়েছে।

ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা জানায়, কোনো শিক্ষার্থী মারা গেলেই আমাদের নতুন নতুন আশ্বাস দেয়া হয়। বলা হয়, ফুটওভারব্রিজ করবে। আমরা এখন আর ফুটওভারব্রিজ চাই না। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই। 

এদিকে মতিঝিলে দেখা গেছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। দুপুরে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সেন্ট্রাল হাইস্কুলের ছাত্ররা শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। 

এসময় তারা ‘জেগেছে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগানও দেয়। সড়কে তাদের অবস্থানের কারণে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

একই দাবিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে সড়ক অবরোধ করে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ধানমন্ডি-২৭ রাপা প্লাজার সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের আশপাশে অবস্থান করতে দেখা গেছে। 

লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা জানায়, আমাদের জন্য ঢাকার সড়ক মোটেও নিরাপদ নয়। শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই মরছে এই সড়কে। নটর ডেমের শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর গতকাল আরেক এসএসসি শিক্ষার্থী মারা গেলো। সুষ্ঠু বিচার ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। সড়ক নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরবো না। একই দাবিতে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর গার্লস কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে বসে বিক্ষোভ করে। 

মোহাম্মদপুর থানার ওসি তদন্ত দুলাল হোসেন বলেন, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক অবরোধ যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সহপাঠী হত্যার বিচার চেয়ে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নীলক্ষেত এলাকায়ও বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়। 

এর আগে নীলক্ষেত মোড় অবরোধের চেষ্টা করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের বাধার কারণে তারা দাঁড়াতে পারেনি। পরে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিলিত হয়ে মিছিল করে।

আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা জানায়, আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছি। রাস্তায় প্রতিদিন শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে। আমরা এর বিচার চাই। আমরা চাই না আর কোনো শিক্ষার্থী বাসের চাকায় পিষ্ট হোক। 

এদিকে নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বনানীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত ছাত্ররা এ সময় ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে। দাবিগুলো হলো— ১. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শিক্ষার্থীসহ সব সড়ক হত্যার বিচার করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; ২. ঢাকাসহ সারা দেশে সব গণপরিবহনে (সড়ক, নৌ, রেলপথ ও মেট্রোরেল) শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে; ৩. গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য যথাস্থানে ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে; ৪. সড়ক দুর্ঘটনায় আহত যাত্রী এবং পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে; ৫. পরিকল্পিত বাস স্টপেজ ও পার্কিং স্পেস নির্মাণ এবং এগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে; ৬. দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা মহলকে নিতে হবে; ৭. বৈধ ও অবৈধ যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনতে হবে এবং বিআরটিএর সব কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে; ৮. আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অবিলম্বে স্বয়ংক্রিয় ও আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে ও ৯. ট্রাফিক আইনের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিষয়টিকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।  

এ ছাড়া গতকাল আন্দোলনের মুখে গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাসমালিকরা। এ ক্ষেত্রে কিছু শর্তও নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। বিআরটিসি বাসে হাফ ভাড়া কার্যকরে দেয়া শর্তগুলোর মতো বাসমালিক সমিতিও শর্ত আরোপ করছে। আর এই শর্তগুলো প্রায়ও একইরকম। ভ্রমণকালে বিআরটিসি বাসের মতোই ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসে ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈধ পরিচয়পত্র সাথে রাখতে হবে। প্রয়োজনে তা প্রদর্শন করতে হবে। 

বিআরটিসি বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়ার সুবিধা পাবে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসে এ সুবিধা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। এ ছাড়াও ছুটির দিন হাফ ভাড়া কার্যকর হবে না। হাফ ভাড়া শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ, অন্যান্য জেলার জন্য নয় বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তবে ঢাকার বাইরে শিক্ষার্থীদের দিতে হবে ফুল ভাড়া। এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাখানও করেছে শিক্ষার্থীরা।

আমারসংবাদ/এআই