ডিসেম্বর ২৪, ২০২১, ১১:০৫ এএম
আফতাব আহমেদ সজল। হতাশা আর অন্ধকার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এক যোদ্ধার নাম। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩৮তম বিসিএসে জায়গা করে নিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে। বর্তমানে সহকারী কমিশনার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত আছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নেত্রকোনায়। সমপ্রতি তিনি হতাশা, পরিকল্পনা এবং সাফল্যর গল্প করেছেন আমার সংবাদের সাথে। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন মুছা মল্লিক।
আপনার ছোটবেলার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই?
আফতাব আহমেদ সজল: বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ওটারা গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলের বন্ধুদের সাথে ঘণ্টাব্যাপী নদীতে গোসল আর খেলাধুলায় কেটেছে দুরন্ত শৈশব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় একদমই মনোযোগ ছিলো না আমার। পরিবারের সদস্যারা একদিক দিয়ে স্কুলে দিয়ে আসলেও আমি অন্য দিক দিয়ে স্কুল পালাতাম। একবার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ঘণ্টার গণিত পরীক্ষায় ১০০ পেয়েছিলাম কিন্তু তখনো পড়াশোনায় মন আসেনি। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মানিবিক বিভাগ থেকে বরিশাল বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করি এবং বরিশাল অমৃত লাল দে কলেজে ভর্তি হই। শহরেই গিয়েই কলেজের প্রাথমিক ফলাফল খুব খারাপ হয়। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি পাশে থেকেছেন, সাহস যুগিয়েছেন। আমার সুখে-অসুখে ভরসা রেখেছেন আমার উপর। পরবর্তীতে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এত চাকরি থাকতে সিভিল সার্ভিসে কেন আসলেন?
আফতাব আহমেদ সজল : মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন একজন (ডিসি) স্যার এসেছিলেন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিদর্শনে। স্যার সেই অনুষ্ঠানে কথা বললেন। কথা শুনছি, কথা বলছি। অথচ মনের ভিতরে চলছিল এক গভীর ঘনঘটা। অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম সেদিনের সেই বিকেলবেলা থেকেই। নিজেই নিজেকে বলেছিলাম কিছু একটা হতে হবে। সেই থেকেই বিসিএস নামক স্বপ্নের শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখতাম বিসিএস উৎসব। একেকটা বিসিএস এর ফলাফল প্রকাশ হত আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের ফলাফল জটলা খুব টানতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের ফলাফল শুনতাম। কোনো কোনো বড় ভাইদের থেকে শুনতাম সিভিল সার্ভিসে কাজের পরিধি বড় এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ বেশি থাকে। ছেলেবেলায় অন্তরে যে বীজ বপন হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে বীজের চারাগাছ জন্ম দিয়েছিল।
বিসিএস এখন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে, আপনি কি মনে করেন?
আফতাব আহমেদ সজল : আমার কাছে মনে হয় ব্যক্তিগত জীবনে যে যতটা সুখী সেটাই তার সাফল্যর মাত্রা। একজন কৃষক, উদ্যোক্তা অথবা ব্যাংকার সবাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশীদার। বিসিএস চেষ্টা থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাম্য নয়। আমাদের মানসিকতাই পারে এই হতাশা হতে পরিত্রাণ দিতে।
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কি ছিল?
আফতাব আহমেদ সজল : ঘুনে ধরা এই সমাজ এবং কিছু মানুষের কথা। সবাই বলত বিয়ে করেছি, চাকরি করছি, তাই কিছুই হবে না আমাকে দিয়ে। কিন্তু আমি জানতাম আমাকে দিয়েই হবে। আমার আত্মবিশ্বাসই আমাকে পরিচালিত করেছে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প জানতে চাই?
আফতাব আহমেদ সজল: আমার জীবনে ধাক্কা খাওয়া একটি প্রশ্ন ছিল- ‘এই তুমি কি চাকরি করো?’ দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছুঁড়ে দেয়া এই একটি প্রশ্ন আমাকে অনেক সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। সাথে সাথে অনেক শক্তিও যুগিয়েছে। আমি থেমে থাকিনি। আমার চেষ্টাই আজকের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। অনেক গল্প রয়েছে জীবনের সাথে ঝলসে যাওয়া জীবনের। কি লাভ সবকিছু জেনে? থাকুক না কিছু অজানা কথা। কি লাভ বিষাদ বাড়িয়ে!
বিসিএস প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছিলেন?
আফতাব আহমেদ সজল : বিসিএস দিতে এসে দেখলাম পড়াশোনার সমুদ্র। ৩৬ তম বিসিএস এবং ৩৭ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি দিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। অনেক একাকীত্ব আর হতাশার এক সময় পার করে নতুন করে প্রস্তুতি শুরু করি। প্রথমেই একটা রুটিন প্রস্তুত করি। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতে শুরু করি। শুরু করি সিলেবাসের নতুন পর্যালোচনা। একের পর এক পরিক্ষা দিয়েও নিজের একটা জায়গা করে নিতে পারছিলাম না। জব সলিউশনসহ বিষয়ভিত্তিক বইগুলোর উপর নতুন করে প্রস্তুতি নিই। প্রিলির জন্য প্রশ্নব্যাংক সলভ করেছিলাম। দুই ঘণ্টার পরীক্ষা দেড় ঘণ্টা শেষ করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি সকল প্রশ্নেই ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ প্রশ্নের উত্তর দিতে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট করে পড়েছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছি তা হল পরীক্ষাকে শুধুই পরিক্ষা বলেই মনে করেছি। আর দয়াময় আল্লাহ উত্তম রিজিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে?
আফতাব আহমেদ সজল: অসময়ের অন্ধকারে খুব অল্প মানুষই পাশে থাকে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার আমার মা, বাবা, আমার স্ত্রী এবং তার পরিবার। শিক্ষকরাও সাহস যুগিয়েছেন অনন্তর। যখন কোন হতাশা আর অন্ধকার জীবনে ভর করেছে, কাউকেই বুঝাতে পারিনি অন্তরের দাগ-জ্বালা তখনও আমার পাশে থেকেছে আমার স্ত্রী। জীবনে কিছু মানুষ থাকে যারা অপরের কল্যাণে নিজের সর্বস্ব দিতে পিছুপা হয় না। আমার কাছে মনে হয়েছে আমার স্ত্রী সেই বিরল মানুষদের একজন। আফতাব আহমেদ সজল থেকে একজন সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আফতাব আহমেদ সজল হয়ে উঠার পেছনে তার ত্যাগ ছিল অনন্য।
কোন বইগুলো সংগ্রহে রাখা জরুরি ?
আফতাব আহমেদ সজল : বিসিএস পরীক্ষার্থীদের শুধু বিসিএস রিলেটেড বই না পড়ে বিশ্ব সাহিত্য এবং বিশ্বের সামগ্রিক বিষয়ের ধারণার জন্য নানান ধরনের বই পড়া খুব দরকার বলে মনে হয়।
নতুনদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?
আফতাব আহমেদ সজল : নতুনদের জন্য বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়ের জ্ঞান, আদর্শ, ও সঠিক দর্শন রাষ্ট্রের উন্নয়নে প্রয়োগ করা খুব জরুরি। নিজের সেরাটা দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে সমর্পণ করার প্রতিশ্রুতি শুরু হোক এখান থেকেই।
দারিদ্র্য কোনো বাধা কি না?
আফতাব আহমেদ সজল : আমার কাছে মনে হয়, যারা আসলেই কিছু করতে চায় তাদের কাছে দারিদ্র্য কিছুই নয়। দারিদ্র্য আমাদের মানসিকতা। আমাদের মননশীলতার উন্নয়ন দরকার।
আমারসংবাদ/এআই